তামাত্তু হজ্জের ১ নাম্বার কাজ হল প্রথমে শুধু উমরার এহরাম বাধতে হবে। এই এহরাম ফরজ। নিম্নে এহরাম সম্পর্কিত মাসায়েল বর্ণনা করা হল। এহরাম কাকে বলে: পুরুষদের জন্য নির্দিষ্ট পোশাক পরিধান পূর্বক হজ্জের বা উমরার অথবা একত্রে হজ্জ ও উমরা উভয়টির নিয়ত করে তালবিয়া পড়া এবং বায়তুল্লাহ শরীফের তওয়াফ ও সাফা-মারওয়া সায়ি করার পর মাথা মুণ্ডন করে বা চুল ছোট করে (মহিলাদের জন্য শুধু চুল ছোট করে) মুক্ত হওয়া পর্যন্ত অবস্থাকে এহরাম বলে। মহিলাদের জন্য নির্দিষ্ট কোন পোশাক নেই। তারা যে কোন পোশাকে এহরাম বাধতে পারেন এবং এহরামের অবস্থায় যে কোন পোশাক পরিধান করতে পারেন। কোথা থেকে এহরাম বাধবেন: হজ্জ বা উমরার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলে মীকাত অর্থাৎ, শরী'আত কর্তৃক এহরাম বাধার নির্ধারিত সীমানা অতিক্রম করার পূর্বেই এহরাম বেধে নেয়া জরুরি। বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তান প্রভৃতি পূর্বাঞ্চলীয় লোকদের জন্য এই নির্ধারিত স্থানটি হল ইয়ালামলাম (মক্কা থেকে দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থিত একটি পাহাড়ের নাম)। সামুদ্রিক জাহাজযোগে হজ্জ যাত্রীগণ এ স্থান বরাবর অতিক্রম করার পূর্বে অবশ্যই এহরাম বেধে নিবেন। প্লেন এ স্থান বরাবর রেখা কখন অতিক্রম করে তা টের পাওয়া কঠিন: তাই প্লেন যোগে হজ্জ বা উমরার উদ্দেশ্যে মক্কা গমনকারীর জন্য প্লেনে আরোহণের পূর্বেই এহরাম বেধে নেয়া উচিত। বিমানবন্দরে গিয়ে বা হাজী ক্যাম্প থেকে বা বাসা থেকে রওয়ানা হওয়ার পূর্বে বাসায় বা মসজিদে যে কোন স্থানে এহরাম বাধা যায়। * যারা মদীনা শরীফ আগে যাওয়ার ইচ্ছা করবেন তারা বিনা এহরামেই রওয়ানা হবেন। মদীনা শরীফ জিয়ারতের পর যখন মক্কা শরীফ-এর উদ্দেশ্যে রওয়ানা হবেন, তখন মদীনা থেকে মক্কা শরীফ গমনকারীদের মীকাত যেহেতু যুলহুলাইফা, তাই যুলহুলাইফা নামক স্থান (বর্তমান নাম "বীরে আলী") থেকে বা মদিনায় থেকেই এহরাম বেধে মক্কা শরীফ রওয়ানা হবেন। * যারা মক্কা শরিফে থেকে নফল উমরা করতে চান, এহরাম বাধার জন্যে তাদেরকে হারামের সীমানার বাইরে গিয়ে এহরাম বেধে আসতে হবে। এর জন্য সবচেয়ে উত্তম স্থান হল তানিম। বর্তমানে সেখানে "মসজিদে আয়েশ" নামক একটি মসজিদ আছে। তাই মসজিদে আয়েশায় গিয়ে এহরাম বেধে এসে নফল উমরা করবেন। জোরানা নামক স্থান থেকেও এহরাম বেধে আসা যায়। এহরাম বাধার তরিকা: * এহরাম বাধার ইরাদা হলে প্রথমে ক্ষৌরকার্য করে নিন- নখ কাটুন, বগল ও নাভির নীচের পশম পরিষ্কার করুন। এগুলো মোস্তাহাব। (পুরুষের) মাথা মুণ্ডানোর অভ্যাস থাকলে মাথা মুক্তিওয়ে নিন অন্যথায় চুল আঁচড়িয়ে নিন। স্ত্রী সম্ভোগ করে নেয়াও মোস্তাহাব। * তারপর এহরামের নিয়তে গোসল করুন, না পারলে উযু করে নিন। এটা সুন্নাত। ভালোভাবে শরীরের ময়লা দূর করবেন। * তারপর পুরুষগণ সেলাই বিহীন (ফাড়া) লুঙ্গি পরিধান করুন অর্থাৎ, একটা চাদর পরিধান করুন এবং একটা চাদর গায়ে জড়িয়ে নিন। এখন ডান বগলের নিচে দিয়ে পরবেন না। এহরামের কাপড় সাদা রঙের হলে উত্তম। এহরামের অবস্থায় শরীরের পরিমাপে সেলাই করা হয়েছে-এমন কাপড় পরিধান করা নিষিদ্ধ; যেমন পায়জামা, পাঞ্জাবী, গেঞ্জি, শার্ট, মোজা, সোয়েটার ইত্যাদি। এহ্রামের কাপড় নতুন বা পরিষ্কার হওয়া উত্তম। * এখন চাদরের ডান অংশকে ডান বগলের নিচে দিয়ে নিয়ে বাম কাঁধের উপর রাখবেন না, এরূপ করাকে 'এজতেবা' বলে। তওয়াফ অবস্থা ব্যতীত অন্য কোন সময় এজতেবা নেই। অতএব এখন স্বাভাবিকভাবে চাদর পরিধান করার মত পরিধান করবেন। মহিলাগণ যে কোন পোশাক পরিধান করতে পারেন। হাত মোজা, পা মোজা, অলংকারও পরিধান করতে পারেন, তবে না করা উত্তম। * তারপর সুগন্ধি লাগিয়ে নিন। এটা সুন্নাত। * তারপর এহরামের নিয়তে দুই রাকাত নফল নামাজ পড়ে নিন। এটা সুন্নাত। এই দুই রাকাতের মধ্যে প্রথম রাকাতে সূরা কাফিরুন এবং দ্বিতীয় রাকাতে সূরা এখলাস পড়া উত্তম। এই নামাজ মাথায় টুপি সহকারে বা মাথা ঢেকেই পড়তে হয়। নামাযের নিষিদ্ধ বা মাকরুহ ওয়াক্তে এহরাম বাধতে হলে এহরামের নামাজ না পড়েই এহরাম বাধতে হয়। মহিলাগণ হায়েয নেফাসের অবস্থায় থাকলে নামাজ না পড়েই এহরাম বেধে নিবেন। * নামাযের পর টুপি খুলে রেখে কেবলামুখী থেকেই এহরামের নিয়ত করতে হবে। মহিলাগণ হায়েয নেফাসের অবস্থায় থাকলে নামাজ পড়া ব্যতীতই কেবলামুখী হয়ে নিয়ত করবেন। বসে বসেই নিয়ত করা উত্তম এবং নিয়ত মুখেও উচ্চারণ করা উত্তম। * এভাবে নিয়ত করুন- اللَّهُمَّ إِنِّي أُرِيدُ الْحَجَّ وَالْعُمْرَةَ فَيَسْرُهُمَا لِي وَتَقَبَّلُهُمَا مِنِّي : (আল্লাহুম্মা ইন্নী উরীদুল উমরাতা ফাইয়াছছির হুমা লী ওয়া তা ক্বাব্বাল্ হুমা মিন্নী।) বাংলায়: হে আল্লাহ, আমি উমরাহ করতে চাই, তুমি আমার জন্য তা সহজ করে দাও এবং আমার থেকে তা কবুল কর। * তারপর তালবিয়া পড়ুন। তালবিয়া পড়া সুন্নাত, তবে নিয়তের সাথে একবার তালবিয়া বা যে কোন যিকির থাকা শর্ত। পুরুষদের জন্য তালবিয়া জোর আওয়াজে পড়া সুন্নাত। মহিলাদের জন্য তালবিয়া জোর আওয়াজে পড়া নিষিদ্ধ। তারা এতটুকু শব্দে পড়বেন যেন নিজ কানে শোনা যায়। * তালবিয়া তিনবার পড়া সুন্নাত। তালবিয়া আরবিতেই পড়া উত্তম। তালবিয়া এই: لَبَّيْكَ اللَّهُمَّ لَبَّيْكَ لَبَّيْكَ لَا شَرِيكَ لَكَ لَبَّيْكَ إِنَّ الْحَمْدَ وَالنِّعْمَةَ لَكَ وَالْمُلْكُ لَا شَرِيكَ لَكَ - (লাব্বাইকা আল্লাহুম্মা লাব্বাইক লাব্বাইকা লা শারীকা লাকা লাব্বাইক ইন্নাল হাম্দা ওয়ান্নি'মাতা লাকা ওয়াল মুল্ক লা শারীকা লাক) অর্থাৎ, আমি হাজির হে আল্লাহ, আমি হাজির। আমি হাজির, কোন শরিক নেই তোমার, আমি হাজির। নিশ্চয়ই সকল প্রশংসা ও নেয়ামত তোমারই, আর সকল সাম্রাজ্যও তোমার, কোন শরিক নেই তোমার। বি. দ্রঃ নিয়ত ও তালবিয়া পাঠ করার পর এহরাম বাধা সম্পন্ন হয়ে গেল। * তারপর দুরুদ শরীফ পড়ুন এবং যা ইচ্ছা আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করুন। তবে এই দুয়া করা উত্তম- اللَّهُمَّ إِنِّي أَسْأَلُكَ رِضَاكَ وَالْجَنَّةَ وَأَعُوذُبِكَ مِنْ غَضَبِكَ وَالنَّارِ - (আল্লাহুম্মা ইন্নী আছআলুকা রিযাকা ওয়াল জান্নাতা, ওয়া আউযু বিকা মিন গযাবিকা ওয়ান্নার।) অর্থাৎ, হে আল্লাহ! আমি তোমার নিকট চাই তোমার সন্তুষ্টি এবং জান্নাত। আর তোমার অসন্তোষ ও জাহান্নাম থেকে তোমার কাছে পানাহ চাই। এহরামের অবস্থায় যা যা করা উত্তম: * এহরামের অবস্থায় অধিক পরিমাণে তালবিয়া পড়তে থাকা উত্তম। বিশেষত গাড়িতে উঠতে, গাড়ি থেকে নামতে, কোন উঁচু স্থানে উঠতে, নীচু স্থানে নামতে, প্রত্যেক নামাযের পর ইত্যাদি মুহূর্তে তালবিয়া পড়া মোস্তাহার। পুরুষগণ তালবিয়া জোর আওয়াজে পড়বেন, তবে এত জোরে নয় যেন নিজের বা কোন নামাজির বা ঘুমন্ত মানুষের অসুবিধা হয়। * ঘর থেকে বের হওয়ার সময়, প্রবেশের সময়, সাক্ষাতের সময়, বিদায়ের সময়, উঠতেবসতে, সকাল-সন্ধ্যায়, মোটকথা যে কোনোভাবে অবস্থার পরিবর্তন হলে সে সময়ে তালবিয়া পড়া মোস্তাহাব। * তালবিয়ার স্থলে لا اله الا الله )লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ) বা الله أكبر (আল্লাহু আকবার) বাক্যগুলোও বলা যায়, তবে তালবিয়ার শব্দগুলো বলাই সুন্নাত। এহরাম অবস্থায় যা যা নিষিদ্ধ : * পুরুষের জন্য শরীরের পরিমাপে বানানো হয়েছে- এমন সেলাই যুক্ত পোশাক নিষিদ্ধ। যেমন জামা, পায়জামা, টুপি, মোজা গেঞ্জি, সোয়েটার ইত্যাদি। মহিলাগণ হাত মোজা, পা মোজা, অলংকারও পরিধান করতে পারেন, তবে না করা উত্তম। * ইচ্ছাকৃত হোক বা অনিচ্ছাকৃত হোক পুরুষদের জন্য মাথা ও চেহারা ঢাকা নিষিদ্ধ। গর্দান ও কান ঢাকা নিষিদ্ধ নয়। মহিলাদের জন্য ইচ্ছাকৃত হোক বা অনিচ্ছাকৃত হোক চেহারা ঢাকা নিষিদ্ধ এবং মাথা খোলা নিষিদ্ধ। মহিলাদেরকে মনে রাখতে হবে চেহারা ঢাকা নিষিদ্ধ- এর অর্থ এই নয় যে, চেহারা সম্পূর্ণ খোলা রাখতে হবে। এরূপ করলে পর পুরুষে চেহারা দেখতে পাবে, এতে গোনাহ হবে। বরং চেহারা ঢাকা নিষিদ্ধ-এর অর্থ হল চেহারার সাথে নেকাব বা কোন কাপড় লাগিয়ে রাখা নিষিদ্ধ। তাদের জন্য এহরাম অবস্থায় পর্দাও করা জরুরি, আবার চেহারায় কোন কাপড় বা নেকাব লাগানোও নিষিদ্ধ। এর উপায় হল তারা চেহারার সাথে লাগতে না পারে এমন কিছু কপালের উপর বেঁধে তার উপর নেকাব ঝুলিয়ে দিবে। মহিলাগণ এ ব্যাপারে গাফিলতি করে থাকেন, এরূপ করা চাই না। মাথার চুল যেন খুলে না যায় সেজন্য মাথায় ছোট রুমাল বেধে নিন। তবে রুমাল যেন কপালে না লাগে। * এমন জুতা পরিধান করা নিষিদ্ধ, যাতে পায়ের মধ্যবর্তী উঁচু হাড় ঢাকা পড়ে যায়। মহিলাদের জন্য এটা নিষিদ্ধ নয়। * সর্ব প্রকার সুগন্ধি ব্যবহার করা নিষিদ্ধ। সুগন্ধি যুক্ত সাবান ব্যবহার করাও নিষিদ্ধ। * নখ চুল পশম কাটা ও কাটানো নিষিদ্ধ। * স্থল ভাগের প্রাণী শিকার করা বা সে কাজে কোন রূপ সহযোগিতা করা নিষিদ্ধ। তবে মশা, মাছি, ছারপোকা, সাপ, বিচ্ছু ইত্যাদি কষ্টদায়ক প্রাণী মারা জায়েয। * স্ত্রী সহবাস বা এতদসম্পর্কিত কোন আলোচনা, চুমু দেয়া এবং শাহওয়াত সহকারে স্পর্শ করা নিষিদ্ধ। * ঝগড়া-বিবাদ করা বা কোন গোনাহের কাজ করা নিষিদ্ধ। এগুলো এমনিতেও নিষিদ্ধ; এহরামের অবস্থায় আরও কঠোর ভাবে নিষিদ্ধ। মনে রাখতে হবে সফরে বিভিন্ন মেজাযের মানুষের সাথে মিশতে হয় বিধায় খুব সহজেই ঝগড়া-বিবাদ লেগে যায়। তাই সকলকেই ধৈর্যের পরিচয় দিতে হবে। * উকুন মারা নিষিদ্ধ। এহরাম অবস্থায় যা যা মাকরুহ: * শরীরের ময়লা পরিষ্কার করা মাকরুহ। * চুল বা দাড়ি বা শরীরে সাবান লাগানো মাকরুহ। * চুলে বা দাড়িতে চিরুনি করা মাকরুহ। * এমন ভাবে চুলকানো মাকরুহ যাতে চুল, পশম বা উকুন পড়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। এরূপ আশঙ্কা হয় না- এমন আস্তে চুলকানো-জায়েয। * এমন ভাবে দাড়ি খেলাল করা মাকরুহ যাতে দু'একটা দাড়ি খসে পড়ার আশঙ্কা হয়। * এহরামের কাপড় সেলাই করে বা গিরা কিংবা পিন ইত্যাদি দিয়ে আটকানো মাকরুহ, তবে কোমরে বেল্ট বাধা জায়েয। তাকার থলি রাখাও জায়েয। * বালিশের উপর মুখ দিয়ে উপুড় হয়ে শয়ন করা মাকরুহ। * সুগন্ধিযুক্ত খাদ্য যদি পাকানো না হয় তবে তা খাওয়া মাকরুহ। পাকানো হলে মাকরুহ নয়। * যৌন উত্তেজনার সাথে স্বামী-স্ত্রীর একে অপরের লজ্জাস্থান দেখা মাকরুহ। * নাক গাল কাপড় দিয়ে ঢাকা মাকরুহ, হাত দিয়ে ঢাকা যায়। * ইচ্ছাকৃত ভাবে কোন সুগন্ধির ঘ্রাণ নেয়া মাকরুহ। * এলাচি, লবঙ্গ বা সুগন্ধিযুক্ত তামাক/জর্দা সহকারে পান খাওয়া মাকরুহ | )معلم الحجاج( এ পর্যন্ত এহরামের বর্ণনা শেষ হল। এরপর মক্কায় প্রবেশ করার সুন্নাত ও আদবসমূহ সম্পর্কে জেনে নিন। মক্কা শরিফে প্রবেশের সুন্নাত ও আদবসমূহ : জেদ্দার পথে মক্কা শরিফে আসতে গেলে মক্কা শরীফের প্রায় ২২ কিলোমিটার দূরে হুদায়বিয়া (বর্তমান নাম শুমাইসি) নামক স্থান অবস্থিত, (এখানে ৬ হিজরি সনে সন্ধি হয়েছিল।) সম্ভব হলে এখানে দুই রাকাত নামাজ পড়ে নিন। এখনই আপনি মক্কর সীমানায় অর্থাৎ, আল্লাহর দরবারের বিশেষ সীমানায় প্রবেশ করতে যাচ্ছেন তাই অত্যন্ত বিনয় ও আদবের সাথে অধিক পরিমাণে তওবা ইস্তেগফার করতে করতে এবং তালবিয়া ও দুরুদ পড়তে পড়তে প্রবেশ করুন এবং আল্লাহ কাছে দুয়া করতে থাকুন। * মসজিদে হারামের উত্তর দিক অর্থাৎ, জান্নাতুল মুআল্লার দিক থেকে প্রবেশ করা মোস্তাহাব। * মক্কা মুকাররমায় প্রবেশের পূর্বে গোসল করা মোস্তাহাব। তবে আজকাল গাড়ি ড্রাইভারগণ পথিমধ্যে সময় দেন না, তাই জেদ্দার থেকেই সম্ভব হলে এ গোসল সেরে নেয়া যেতে পারে। আর যারা মদীনা থেকে মক্কর দিকে আসবেন, তারা মদীনা থেকেই এ গোসল সেরে নিতে পারেন। এ পর্যন্ত এহরাম সম্পর্কিত আলোচনা সমাপ্ত হল।
তামাত্তু হজে ২ নাম্বার কাজ হল বায়তুল্লাহয় প্রবেশ করে উমরার তওয়াফ করা। এটাকে তওয়াফে উমরা বা উমরার তওয়াফ বলে। এই তওয়াফ উমরার ফরজ। * মক্কা মুকাররমায় এসে মাল-সামান বন্দোবস্ত করা ইত্যাদি জরুরি কাজ থাকলে তা সেরে তওয়াফের জন্য যথাসম্ভব দ্রুত মসজিদে হারামে হাজির হওয়া মোস্তাহাব। মহিলাগণ হায়েয নেফাস অবস্থায় থাকলে মসজিদে প্রবেশ ও তাওয়াফ করতে পারবেননা। নিম্নে মসজিদে হারামে প্রবেশ করার তরিকা এবং তখনকার কতিপয় আমল সম্পর্কে বর্ণনা পেশ করা হল। তারপর তওয়াফের তরিকা ও মাসায়েল বর্ণনা করা হবে। মসজিদে হারামে প্রবেশ করার তরিকা ও তখনকার আমল : * মসজিদে হারামের যে কোন দরজা দিয়ে প্রবেশ করা যায়, তবে "বাবুস সালাম" নামক দরজা (২৪ নং গেট) দিয়ে প্রবেশ করা মোস্তাহাব। এ দরজাটি মসজিদে হারামের পূর্বদিকে সাফা ও মারওয়ার মাঝামাঝি অবস্থিত। ভিড়ের সময় বাবুস সালাম নীচ দিয়ে প্রবেশ করা যায়না, তখন বাবুস সালাম ওভারব্রিজ দিয়ে প্রবেশ করতে পারেন। * প্রবেশ করার সময় তালবিয়া পড়তে পড়তে আল্লাহ আজমত ও বড়াই মনে জাগ্রত রেখে অত্যন্ত বিনয় ও খুশু-খুযুর সাথে প্রবেশ করুন। * প্রবেশের সময় মসজিদে প্রবেশের যে সুন্নাত ও আদব রয়েছে তার প্রতিও খেয়াল রাখতে হবে। মসজিদে হারাম সহ সব মসজিদে প্রবেশের সময়ই বিষয়গুলো আমল করবেন। নিম্নে সে বিষয়গুলো বর্ণনা করা হল। মসজিদে প্রবেশের সুন্নাত ও আদব সমূহ ১. নত চোখে, ভীত মনে মসজিদে প্রবেশ করবেন। ২. মসজিদে প্রবেশের পূর্বে জুতা/স্যান্ডেল খুলে নিবেন। জুতা/স্যান্ডেল ভিতরে নিতে হলে ঝেড়ে পরিষ্কার পূর্বক নিবেন। ৩. প্রথমে বাম পায়ের জুতা/স্যান্ডেল তারপর ডান পায়ের জুতা/স্যান্ডেল খুলবেন। ৪. প্রবেশের পূর্বে বিসমিল্লাহ পড়বেন। ৫. দুরুদ ও সালাম পড়বেন। ৬. দুয়া পড়বেন। এই তিনটাকে একত্রে এভাবে পড়া যায়- بِسْمِ اللَّهِ وَالصَّلَوةُ وَالسَّلَامُ عَلَى رَسُولِ اللَّهِ اللَّهُمَّ افْتَحْ لِي أَبْوَابَ رَحْمَتِكُ - বিসমিল্লাহি ওয়াস্সলাতু ওয়াস্স্সালামু আলা রসূলিল্লাহি আল্লাহুম্মাফ তাহলী আবওয়াবা রহমাতিক।) অর্থ হে আল্লাহ, আমার সমস্ত গোনাহ মাফ কর এবং আমার জন্য তোমার রহমতের দরজাসমূহ খুলে দাও। * প্রবেশ করত যতক্ষণ মসজিদে থাকবেন নফল এ'তেকাফের নিয়ত করে নিবেন। নফল এ'তেকাফের নিয়ত এভাবে করতে পারেন- نَوَيْتُ سُنَّةَ الْاعْتِكَافُ (নাওয়াইতু সুন্নাতাল ই'তিকাফ) বাংলায়: আমি নফল এ'তেকাফের নিয়ত করলাম। * প্রবেশ করত সামনের দিকে নজর দিলে কাল গেলাফ সজ্জিত আল্লাহর ঘর কা'বা শরীফ নজরে আসবে। কা'বা শরীফ প্রথমে নজরে আসলেই তিনবার পড়ুন- اَللَّهُ أَكْبَرَ لَا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ (আল্লাহু আকবার লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ) * তিনবার উপর্যুক্ত দুআটি পড়ার পর দাঁড়ানো অবস্থাতেই বুক পর্যন্ত হাত তুলে আপনার আবেগাপ্লুত মন থেকে যে দু'আ আসে আল্লাহর কাছে তা প্রার্থনা করুন। এ মুহূর্ত দু'আ কবুল হওয়ার একটি বিশেষ মুহূর্ত। এ মুহূর্তে এ দুআটি পড়াও মোস্তাহাব- اعُوذُ بِرَبِّ الْبَيْتِ مِنَ الدَّيْنِ وَالْفَقْرِ وَمِنْ ضِيقِ الصَّدْرِ وَعَذَابِ الْقَبْرِ (আউযু বিরব্বিল বাইতি মিনাদ্দাইনি ওয়াল ফক্কড়ি ওয়ামিন দ্বীক্কিস সদ্রি ওয়া 'আযাবিল কুবরি।) অর্থাৎ, আমি এই গৃহের রবের কাছে পানাহ চাই ঋণী হওয়া, দরিদ্র হওয়া, মন সংকুচিত হওয়া এবং কবরের আজাব থেকে। * বায়তুল্লাহ (কা'বা শরীফ) প্রথমে নজরে আসর সময় পারলে এ দুআটিও পড়ুন- اللَّهُمَّ زِدْ هَذَا الْبَيْتَ تَشْرِيفًا وَتَعْظِيمًا وَتَكْرِيمًا وَّمَهَابَةً ، وَزِدْ مَنْ شَرَّفَهُ وَكَرَّمَهُ مِمَّنْ حَجَّهُ وَاعْتَمَرَهُ تَشْرِيفًا وَتَكْرِيمًا وَتَعْظِيمًا وَبِرًّا، اللَّهُمَّ أَنتَ السَّلَامُ وَمِنْكَ السَّلَامُ فَحَيْنَا رَبَّنَا بِالسَّلَامِ - (আল্লাহুম্মা জিদ হাযাল বাইতা তাশরীফাওঁ ওয়া তা'যীমাওঁ ওয়া তাকরীমাওঁ ওয়া মাহাবাহ, ওয়া জিদ মান শার্রফাহু ওয়া কার্রমাহু মিম্মান হাজ্জাহু ওয়া'তামারাহু তাশরীফাওঁ ওয়া তাকরীমাওঁ ওয়া তা'যীমাওঁ ওয়া বিরর। আল্লাহুম্মা আন্তাস্ সালামু ওয়া মিনকাস সালামু ফাহাইয়্যিনা রব্বানা বিস্সালাম।) অর্থ: হে আল্লাহ! এই গৃহের মর্যাদা, সম্মান, মাহাত্ম্য ও গাম্ভীর্য বৃদ্ধি করে দাও। যারা হজ্জ ও উমরা উপলক্ষ্যে এই গৃহে আগমন করে, তাদের মর্যাদা, সম্মান, মাহাত্ম্য, গাম্ভীর্য ও নেকী বৃদ্ধি করে দাও। হে আল্লাহ! তুমি শান্তিময়, তোমার থেকেই শান্তি প্রাপ্তি হয়ে থাকে। অতএব হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদেরকে শান্তির জীবন দান কর। * মসজিদে হারামে প্রবেশ করে সুন্নাতে মুয়াক্কাদা পড়তে হলে পড়ুন নতুবা তওয়াফ শুরু করুন। এখানে দুখুলুল মসজিদ (দুই রাকাত) পড়া নিয়ম নয়। তবে তওয়াফ করতে গেলে ফরজ নামাজ কাযা হওয়ার বা জামা'আত ছুটে যাওয়ার বা মোস্তাহাব ওয়াক্ত চলে যাওয়ার আশঙ্কা হলে তওয়াফের স্থলে দুই রাকাত দুলুল মসজিদ পড়ে নেয়া চাই, যদি মাকরুহ ওয়াক্ত না হয়। * বায়তুল্লাহয় প্রবেশ করত উমরার তওয়াফ করবেন। নিম্নে তওয়াফের মাসায়েল ও নিয়ম কানুন বর্ণনা করা হল। তওয়াফের তরিকা ও মাসায়েল * তওয়াফ শুরু করার পূর্ব মুহূর্তে চাদরের ডান অংশকে ডান বগলের নিচে দিয়ে নিয়ে বাম কাঁধের উপর রেখে দিন, এরূপ করাকে 'এজতেরা' বলে। সম্পূর্ণ তওয়াফে এরূপ রাখতে হবে। এই এজতেবা করা সুন্নাত। তওয়াফ অবস্থা ব্যতীত অন্য কোন সময় এজতেবা করবেন না। যে তওয়াফের পর সায়ি নেই সে তওয়াফেও এজতেবা' করবেন না। নফল তওয়াফের পর যেহেতু সায়ি নেই, তাই নফল তওয়াফেও এজতেবা' হবে না। মহিলাদেরকে কখনও এজতেবা করতে হবে না। * অতঃপর কা'বা শরীফের দিকে ফিরে হাজরে আসওয়াদকে ডান দিকে রেখে দাঁড়ান অর্থাৎ, হাজরে আসওয়াদ বরাবর মসজিদে হারামের গায়ে যে সবুজ বাতি আছে সেটাকে পিছন দিকে ডান পার্শ্ব বরাবর রেখে এমন ভাবে দাঁড়ান, যেন হাজরে আসওয়াদ ডান কাঁধ বরাবর থাকে এবং এ পর্যন্ত যে তালবিয়া পড়ে আসছিলেন তা পড়া বন্ধ করুন, এই এহরাম শেষ হওয়া পর্যন্ত আর তালবিয়া পড়বেননা আবার হজ্জ বা উমরার এহরাম বাধলে তালবিয়া শুরু হবে। * তারপর তওয়াফের নিয়ত করুন। নিয়ত করা শর্ত। শুধু এতটুকু নিয়ত করলেই যথেষ্ট যে, হে আল্লাহ! আমি তোমার ঘর তওয়াফ করার নিয়ত করছি। তুমি তা সহজ করে দাও এবং কবুল কর। তবে উমরার তওয়াফ এ কথাটি নির্দিষ্ট করে নিয়ত করা উত্তম। * আরবিতে নিয়ত করতে চাইলে এভাবে করা যায়- اللَّهُمَّ إِنِّي أُرِيدُ طَوَافَ بَيْتِكَ الْحَرَامِ فَيَسِرُهُ لِى وَتَقَبَّلُهُ مِنِّي - (আল্লাহুম্মা ইন্নী উরীদু তওয়াফা বাইতিকাল হারামি ফাইয়াছছিরহু লী ওয়া তাক্বাব্বালহু মিন্নী।( كتاب ادعية الحج والعمرة) অর্থাৎ, হে আল্লাহ! আমি তোমার ঘরের তওয়াফ করার নিয়ত করছি, তুমি সহজ করে দাও এবং কবুল করে নাও। * নিয়ত করার পর বায়তুল্লাহ্ দিকে ফেরা অবস্থায়ই ডান দিকে এতটুকু সরে দাঁড়ান যেন হাজরে আসওয়াদ ঠিক আপনার বরাবর হয়ে যায়। অতঃপর নামাযে নিয়ত বাধার সময় যেভাবে দুই হাত কান পর্যন্ত উঠাতে হয় সেভাবে দুই হাত কান পর্যন্ত (মহিলাগণ বুক বরাবর) উঠিয়ে হাজরে আসওয়াদের দিকে মুখ করে পড়ুন- بِسْمِ اللهِ اللَّهُ أَكْبَرُ لَا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ وَلِلَّهِ الْحَمْدُ ، وَالصَّلُوةُ وَالسَّلَامُ عَلَى رَسُولِ اللَّهُ (বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ, ওয়া লিল্লাহিল হাম্দ, ওয়াস্ সলাতু ওয়াস্ সালামু 'আলা রসুলিল্লাহ।) অর্থ: আল্লাহর নামের সাহায্য কামনা করে শুরু করছি। আল্লাহ সবচেয়ে বড়। আল্লাহ ব্যতীত কোন মা'বুদ নেই এবং আল্লাহরই জন্য সকল প্রশংসা। আর দুরুদ ও সালাম আল্লাহর রসুলের প্রতি। * পারলে (মুলতাযাম বরাবর গিয়ে) এর সাথে আরও পড়ুন-اللَّهُمَّ إِيْمَانًا بِكَ ، وَتَصْدِيقًا بِكِتَابِكَ ، وَوَفَاء بِعَهْدِكَ ، وَاتَّبَاعًا لِسُنَّةِ نَبِيِّكَ مُحَمَّدٍ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّم - (كتاب ادعية الحج والعمرة) (আল্লাহুম্মা ঈমানাম্ বিকা ওয়া তাসদীক্বাম বিকিতাবিকা, ওয়া ওয়াফাআম বি'আহদিকা ওয়া ইত্তিবা'আন্ লিসুন্নাতি নাবিয়্যিকা মুহাম্মাদিন সাল্লাল্লাহু তা'আলা 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম।) অর্থ হে আল্লাহ! তোমার প্রতি ঈমান-বিশ্বাস নিয়ে, তোমার প্রেরিত কিতাবের প্রতি ঈমান-বিশ্বাস নিয়ে, তোমার নির্দেশ পালনার্থে এবং তোমার নবি মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম -এর আদর্শ অনুসরণ করণার্থে (এই তওয়াফ করছি)। * তারপর হাত নামিয়ে ফেলুন। * তারপর ধাক্কাধাক্কি করে কাউকে কষ্ট দেয়া ছাড়া সম্ভব হলে হাজরে আসওয়াদকে সরাসরি মুখ দিয়ে চুমু দিন। কাউকে কষ্ট দিয়ে চুমু দেয়া নিষেধ। এই চুমু দেয়া সুন্নাত। তিনবার চুমু দেয়া মোস্তাহাব। চুমুতে যেন শব্দ না হয়। প্রতিবার চুমু দেয়াড় পর মাথা হাজরে আসওয়াদের উপর রাখাও মোস্তাহাব। ভিড়ের কারণে মুখ দিয়ে চুমু দেয়া সম্ভব না হলে হাত দ্বারা হাজরে আসওয়াদ স্পর্শ করে হাতে চুমু দিন। তাও সম্ভব না হলে কোন লাঠি থাকলে তা দ্বারা স্পর্শ করে তাতে চুমু দিন। তাও সম্ভব না হলে দুই হাতের তালু দিয়ে হাজরে আসওয়াদের দিকে ইশারা করে দুই হাতেই চুমু খান। হাত দ্বারা ইশারা করার সময় হাত এতটুকু উঠাবেন যে, হাতের তালু হাজরে আসওয়াদের দিকে থাকবে এবং হাতের পিঠ চেহারার দিকে থাকবে। এ সময় নিম্নোক্ত দু'আ পড়ুন- اللَّهُ أَكْبَرُ لَا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ وَالْحَمْدُ لِلَّهِ وَالصَّلَوةُ عَلَى سَيِّدِنِ الْمُصْطَفَى صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمُ - (আল্লাহু আকবার, লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ, ওয়ালহাম্দু লিল্লাহ, ওয়াস্ সলাতু ওয়াস্ সালামু 'আলা সায়্যিদিনিল মুস্তফা সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম।) অর্থ আল্লাহ সবচেয়ে বড়। আল্লাহ ব্যতীত কোন মা'বুদ নেই। সমস্ত প্রশংসা আল্লাহরই জন্য। আর দুরুদ সর্দার মোস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর প্রতি। তবে উল্লেখ্য যে, আজকাল অনেকে হাজরে আসওয়াদ, মুলতাজাম, রুকুনে ইয়ামানী প্রভৃতি স্থানে সুগন্ধি মেখে দিয়ে থাকেন তাই এব্রামের অবস্থায় যে তাওয়াফ হয় তাতে সরাসরি এ সব স্থান স্পর্শ করা থেকে বিরত থাকা উচিত। আরও মনে রাখা দরকার যে, হাজরে আসওয়াদের চতুর্পাশ্বে যে রূপার বেষ্টনী রয়েছে তাতে চুমু দেয়া বা তাতে মাথা কিংবা হাত রাখা জায়েয নয়। * চুমু দেয়াড় পর পা দুটো স্বস্থানে রেখে একটু ডান দিকে ঘুরে দাঁড়ান, তাহলে কা'বা শরীফ আপনার বাম দিকে হয়ে যাবে। এভাবে কা'বা শরীফকে বাম দিকে রেখে তওয়াফ আরম্ভ করুন। কখনও যেন বুক কা'বা শরীফের দিকে ফিরিয়ে তওয়াফ না হয়। দুই এক কদমও যেন এমন না হয়। এমন হলে সেই পরিমাণ জায়গা পিছে এসে কা'বা শরীফকে বাম দিকে রেখে পুনরায় সামনে অগ্রসর হবেন। তওয়াফ করার সময় কা'বা শরীফের দিকে দৃষ্টিও ফেরাবেন না। * পুরুষদের জন্য তওয়াফের সাত চক্করের মধ্যে প্রথম তিন চক্করে বীরের ন্যায় বুক ফুলিয়ে কাঁধ দুলিয়ে ঘন ঘন কদম ফেলে কিছুটা দ্রুত গতিতে চলতে হবে। এরূপ করাকে 'রমল' বলা হয়। রমল করা সুন্নাত। মহিলাগণ রমল ব্যতীত স্বাভাবিকই চলবেন। * তওয়াফ হাতিমের বাইরে দিয়ে করা ওয়াজিব। হাতীম হল বায়তুল্লাহ শরীফের উত্তর দিকে বুক সমান উঁচু দেয়াল ঘেরা স্থান। এই হাতিমের বাইরে দিয়ে তওয়াফ করতে হবে। * ভিড় না থাকলে এবং কাউকে কষ্ট দেয়া না হলে যথাসম্ভব বায়তুল্লাহর কাছাকাছি দিয়ে তওয়াফ করা উত্তম। তবে মহিলাদের জন্য বায়তুল্লাহ্ কাছাকাছি দিয়ে নয় বরং দূর দিয়ে তওয়াফ করা উত্তম এবং তাদের জন্য রাতের বেলায় তওয়াফ করা উত্তম। তবে যদি পর্দার ব্যাঘাত না ঘটে কিংবা কারও কষ্ট না পৌঁছে, তাহলে বায়তুল্লাহর কাছাকাছি দিয়ে তওয়াফ করা উত্তম। * প্রথম চক্করে রুকুনে ইয়ামানীতে (কা'বা শরীফের দক্ষিণ পশ্চিম কোণে) পৌঁছার পূর্বে বিভিন্ন দু'আ পড়া হয়ে থাকে; রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে সেসব দুয়া বর্ণিত নেই- তবে সেসব দু'আ পড়া যায় বা অন্য যে কোন দুয়া করা যায়, যে কোন যিকির করা যায়। সাত চক্করে এরকম বিভিন্ন দুয়া বর্ণিত আছে, সবগুলো সম্পর্কেই এ কথা। দুয়া কিতাব দেখেও পড়া যায়। দুয়া মোনাজাতের জন্য হাত উঠাবেন না। * রুকুনে ইয়ামানীতে পৌঁছে সম্ভব হলে দুই হাতে কিংবা শুধু ডান হাতে রুকুনে ইয়ামানী স্পর্শ করা মোস্তাহাব। এখানে চুমু খাবেন না বা হাতের দ্বারা স্পর্শ করে সেই হাতেও চুমু খাবেন না বা স্পর্শ করা সম্ভব না হলে দূর থেকে ইশারাও করবেন না। * তারপর রুকনে ইয়ামানী থেকে হাজরে আসওয়াদের কোণে যাওয়া পর্যন্ত নিম্নোক্ত দুয়া পড়া মোস্তাহাব। প্রত্যেক চক্করেই এই স্থানে এ দুআটি পড়তে হয়। اللهُمَّ إِنِّي أَسْأَلُكَ الْعَفْوَ وَالْعَافِيَةَ فِي الدُّنْيَا وَالاْخِرَةِ - رَبَّنَا آتِنَا فِي الدُّنْيَا حَسَنَةً وَفِي الْآخِرَةِ حَسَنَةً وَقِنَا عَذَابَ النَّارِ، يَا عَزِيزُ يَا غَفَّارُ يَا رَبَّ الْعَلَمِينَ (রব্বানা আতিনা ফিদ দুনইয়া হাছানাতাও ওয়াফিল আখিরাতি হাছানাতাও ওয়াক্বিনা 'আযাবান্নার, ইয়া 'আযীযু ইয়া গাফ্ফারু ইয়া রাব্বুল আলামীন।) অর্থ হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদেরকে দান কর দুনিয়াতে কল্যাণ এবং আখেরাতেও কল্যাণ। আর আমাদেরকে জাহান্নামের শাস্তি থেকে বাঁচাও হে পরাক্রমশালী, হে মহা ক্ষমাপরায়ণ, হে জগৎসমূহের প্রতিপালক! * তারপর হাজরে আসওয়াদ বরাবর পৌঁছলে এক চক্কর পূর্ণ হয়ে গেল। এখন সম্ভব হলে بِسْمِ اللهِ اَللهُ أَكْبَرُ )বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার) বলে আবার পূর্বের নিয়মে হাজরে আসওয়াদে চুমু খাবেন বা হাতে স্পর্শ করে বা দুই হাতে ইশারা করে হাতে চুমু খাবেন। ইশারা করার জন্য পা দুটো যথাস্থানে সামনের দিকে ফেরানো অবস্থায় রেখে শুধু চেহারা ও বুক যতটুকু ফেরাতে হয় ততটুকু কা'বা শরীফের দিকে করে নিবেন। প্রত্যেক চক্করের শুরুতেই এভাবে চুমু খাবেন। তবে প্রথম বারের ন্যায় হাত কান বরাবর উঠাবেন না, এটা শুধু তওয়াফ শুরু করার সময়েই করতে হয়। তবে চুমু খাওয়ার জন্য হাত দ্বারা ইশারা করতে হলে পূর্বের নিয়মে তা করবেন। * চুমু খাওয়ার পর দ্বিতীয় চক্কর শুরু করবেন এবং পূর্বের ন্যায় রুকুনে ইয়ামানীতে সম্ভব হলে হাত দ্বারা স্পর্শ করবেন। তারপর রব্বানা আতিনা ফিদ দুনিয়া হাছানাতাও ওয়াফিল আখিরাতি হাছানাতাও ওয়াক্বিনা 'আযাবান্নার, ইয়া 'আযীযু ইয়া গাফ্ফারু ইয়া রাব্বুল 'আলামীন পড়তে পড়তে হাজরে আসওয়াদ বরাবর পৌঁছবেন। এভাবে দ্বিতীয় চক্কর পূর্ণ হয়ে গেল। এভাবে সাত চক্কর শেষ হওয়ার পর আবার হাজরে আসওয়াদে পূর্বের মত চুমু খাবেন। এটা হবে অষ্টম বার চুমু খাওয়া। এই অষ্টমবার চুমু খাওয়ার ইশারা করতে গিয়ে চেহারা, বুক ও দুই পা সহাই কা'বা শরীফের দিকে ফিরতে পারেন। এখন আপনার উমরার তওয়াফ শেষ হল। এখন পুরুষগণ চাদরের এজতেবা খুলে ডান কাঁধ ঢেকে নিবেন। * সম্পূর্ণ তওয়াফ উযু অবস্থায় হতে হবে। প্রথম চার চক্কর পর্যন্ত উযু ছুটে গেলে উযু করে আবার প্রথম থেকে তওয়াফ শুরু করতে হবে। আর যদি চার চক্করের পর উযু ছুটে, তাহলে ইচ্ছা- উযু করে আবার প্রথম থেকেও তওয়াফ শুরু করা যায়, কিংবা যেখান থেকে উযু ছুটেছে সেখান থেকেই বাকিটা পূর্ণ করে নেয়া যায়। বি. দ্রঃ অপবিত্র বা বে উযু অবস্থায় তওয়াফ করলে সে সম্পর্কিত আরও বিস্তারিত মাসায়েলের জন্য দেখুন ১৮৫ নং পৃষ্ঠা। * তওয়াফ শেষ করার পর যদি বেশী ভিড় ও ধাক্কাধাক্কি না হয়, তাহলে হাজরে আসওয়াদ ও কা'বা ঘরের দরজার মধ্যবর্তী স্থানকে (এ স্থানকে 'মুলতাযাম' বলা হয়।) আঁকড়ে ধরবেন, বুক এবং চেহারা দেয়ালের সাথে লাগাবেন এবং উভয় হাত উপরে উঠিয়ে দেয়ালে স্থাপন করে খুব কাকুতি-মিনতি সহকারে দুয়া করবেন। এটা দুয়া কবুল হওয়ার স্থান। এ স্থানে এরূপ দুয়া করা সুন্নাত। তবে এই সুন্নাত আদায় করতে গিয়ে ধাক্কাধাক্কি করে কাউকে কষ্ট দেওয়া অন্যায়, কেননা কাউকে কষ্ট দেয়া হারাম। আপনার দ্বারা কোন লোকের এরূপ কষ্ট পাওয়ার আশঙ্কা থাকলে এটা ছেড়ে দিতে হবে। এমনিভাবে মহিলাদের পর্দা ও শালীনতা রক্ষার স্বার্থেও এ থেকে এবং কা'বা শরীফের দরজা মোবারকের চৌকাঠ ধারে দুয়া করা থেকে বিরত থাকা উচিত। * তারপর কা'বা শরীফের দরজা মোবারকের চৌকাঠ ধরে দুয়া করুন। সম্ভব হলে গেলাফ আঁকড়ে ধরে খুব কান্না কাটি করুন।তবে এহরাম অবস্থায় থাকলে এসব স্থানে সতর্ক থাকতে হবে যেন কা'বা শরীফের গেলাফ মাথায় না লাগে। এই সুন্নাত আদায় করতে গিয়ে ধাক্কাধাক্কি করে কাউকে কষ্ট দেওয়া অন্যায়, কেননা কাউকে কষ্ট দেয়া হারাম। আপনার দ্বারা কোন লোকের এরূপ কষ্ট পাওয়ার আশঙ্কা থাকলে এটা ছেড়ে দিতে হবে। * তারপর দুই রাকাত নামাজ পড়া ওয়াজিব, এটাকে সালাতুতত্তাওয়াফ বা তওয়াফের নামাজ বলে। এই নামাজ 'মাকামে ইবরাহীম'-এর পিছনে পড়া মোস্তাহাব। ('মাকামে ইবরাহীম' একটি বেহেস্তী পাথরের নাম, যার উপর দাঁড়িয়ে হজরত ইবরাহীম [আঃ] কা'বা শরীফের উঁচু দেয়াল নির্মাণ করেছিলেন। তখন প্রয়োজন অনুসারে এ পাথরটি আপনা আপনি উপরে নিচে উঠানামা করত। এ পাথরের গায়ে হজরত ইবরাহীম [আঃ]-এর কদম মুবারকের চিহ্ন রয়েছে। পাথরটি কা'বা শরীফের পূর্ব দিকে একটি পিতলের জালির মধ্যে রাখা অবস্থায় সংরক্ষিত আছে। অনেকে এই জালির গায়ে হাত লাগায় বা জ্বালতে চুমু দেয়। এটা ঠিক নয়।) * ভিড়ের কারণে মাকামে ইবরাহীমের কাছে এই দুই রাকাত পড়া সম্ভব না হলে আসে পাশে পড়ে নিবেন। তাও সম্ভব না হলে দূরবর্তী যেখানে সম্ভব পড়ে নিবেন। তখন নিষিদ্ধ বা মাকরুহ ওয়াক্ত না হলে তওয়াফ শেষ হওয়ার সাথে সাথে এ নামাজ পড়ে নেয়া সুন্নাত। আর তখন নিষিদ্ধ ওয়াক্ত বা মাকরুহ ওয়াক্ত হলে পরে সহিহ ওয়াক্তে পড়ে নিতে হবে। মাকামে ইবরাহীমের দিকে যাওয়ার সময় নিম্নোক্ত দুয়া পড়তে পড়তে যাবেন। وَاتَّخِذُوا مِنْ مَقَامِ إِبْرَاهِيمَ مُصَلَّى (ওয়াত্তাখিযূ মিম্ মকামি ইবরাহীমা মুসল্লা) * এই নামাযে প্রথম রাকাতে সূরা কাফিরুন এবং দ্বিতীয় রাকাতে সূরা এখলাস পড়ুন। এই নামাযের পরও দুয়া কবুল হয়ে থাকে। * তওয়াফের দুই রাকাত নামাজ পড়ার পর জমজম কুয়ার নিকট গিয়ে যমযমের পানি পান করা এবং দুয়া করা মোস্তাহাব। এটাও দুয়া কবুল হওয়ার স্থান। যমযমের পানি কা'বা শরীফের দিকে মুখ করে পান করা মোস্তাহাব। (উল্লেখ্য বর্তমানে জমজম কুয়ার কাছে যাওয়া যায়না। এ ক্ষেত্রে আশ পাশ থেকেই যমযমের পানি পান করে নিন।) * এ পানি দাঁড়িয়ে বসে উভয়ভাবে পান করা যায়। )رد المحتار( * যমযমের পানি পান করার সময় নিম্নোক্ত দুয়া পড়তে হয়- اللَّهُمَّ إِنِّي أَسْأَلُكَ عِلْمًا نَافِعًا وَرِزْقًا وَّاسِعًا وَشِفَاءٌ مِّنْ كُلِّ دَاءٍ - (আল্লাহুম্মা ইন্নী আহ্আলুকা ইল্ল্মান্ নাফি'আওঁ ওয়া রিজক্বান ওয়াছিআওঁ ওয়া শিফাআম্ মিন্ কুল্লি দা।) [মুস্তাদরকে হাকিম] অর্থ হে আল্লাহ, আমি তোমার নিকট চাই উপকারী জ্ঞান এবং প্রশস্ত রিযিক, আর সব রোগ-ব্যাধি থেকে শেফা। এ পর্যন্ত উমরার তওয়াফ ও তার আনুষঙ্গিক কার্যাবলী সম্পন্ন হল। এরপর উমরার সায়ি করতে হবেন।
তামাত্তু হজ্জের ৩ নাম্বার কাজ হল উমরার 'সায়ি' করা। এই সায়ি ওয়াজিব। নিম্নে সায়ি সম্বন্ধে বিস্তারিত বর্ণনা পেশ করা হল। সায়ীর তরিকা ও মাসায়েল * তওয়াফ ও তার আনুষঙ্গিক কার্যাবলী শেষ করার পর সায়ি করার উদ্দেশ্যে ছাফা পাহাড়ের দিকে অগ্রসর হওয়ার পূর্বে হাজরে আসওয়াদকে তওয়াফে বর্ণিত নিয়ম অনুযায়ী চুমু দিয়ে যাবেন। * তওয়াফের পর বিলম্ব না করেই সায়ি করা সুন্নাত। * সায়ি করার জন্য 'বাবুস সাফা' অর্থাৎ, সাফা দরজা দিয়ে বের হওয়া মোস্তাহাব। অন্য যে কোন দরজা দিয়ে বের হওয়া জায়েয। এই দরজা দিয়ে বের হওয়ার সময় আপনি মসজিদ থেকে বের হচ্ছেন, তাই মসজিদ থেকে বের হওয়ার নিয়ম ও দুআগুলোও আমল করবেন। মসজিদে হারাম সহ সব মসজিদ থেকে বের হওয়ার সময়ই এগুলো আমল করবেন। অর্থাৎ, নিম্নোক্ত ৫টি আমল করবেন। ১. বিসমিল্লাহ পড়বেন। ২. দুরুদ ও সালাম পড়বেন। ৩. বের হওয়ার দুয়া পড়বেন। এই তিনটাকে একত্রে এভাবে পড়া যায়- بِسْمِ اللَّهِ وَالصَّلَوةُ وَالسَّلَامُ عَلَى رَسُولِ اللَّهِ . اللَّهُمَّ إِنِّي أَسْأَلُكَ مِنْ فَضْلِكَ - (বিসমিল্লাহি ওয়াসালাতু ওয়াস্সালামু আলা রসূলিল্লাহি আল্লাহুম্মা ইন্নী আছআলুকা মিন ফাদলিক।) অর্থ হে আল্লাহ! আমার সমস্ত গোনাহ মাফ কর এবং আমার জন্য তোমার অনুগ্রহ (বা রিযিকের) দরজাগুলো খুলে দাও। ৪. বাম পা আগে বের করবেন। ৫. তারপর ডান পা বের করবেন। * সাফা পাহাড়ের নিকটবর্তী গিয়ে এই দু'আ পড়া মোস্তাহাব- أَبَدًا بِمَا بَدَا اللهُ بِه إِنَّ الصَّفَا وَالْمَرْوَةَ مِنْ شَعَائِرِ الله - (আব্দাউ বিমা বাদাআল্লাহু বিহি ইন্নাস্ সফা ওয়াল মার্ ওয়াতা মিন শা'আইরিল্লাহ।) অর্থ: শুরু করছি সেই পাহাড় দিয়ে, যে পাহাড়ের কথা দিয়ে আল্লাহ শুরু করেছেন। নিশ্চয় সাফা ও মারওয়া পাহাড়দ্বয় আল্লাহর দ্বীনের নিদর্শনসমূহের অন্তর্ভুক্ত। * সাফা পাহাড়ের এতটুকু উঁচুতে উঠবেন যেন বাবুস সাফা দিয়ে কা'বা শরীফ নজরে আসে-এর চেয়ে বেশী উপরে উঠা নিয়মের খেলাফ বরং এতটুকুই উপরে উঠা সুন্নাত। পুরুষদের ভিড় থাকলে মহিলাগণ উঁচুতে উঠবেন না। * কা'বা শরীফ নজরে আসলে কা'বার দিকে নজর করে দুয়া করার সময় যে রকম হাত উঠানো হয় সে রকম করে দুই হাত কাঁধ বরাবর উঠিয়ে (কান পর্যন্ত হাত উঠানো ভুল এবং সুন্নাতের খেলাফ) তিন বার আওয়াজ সহকারে নিম্নোক্ত দুয়া পড়ুন। এটা মোস্তাহাব। الْحَمْدُ لِلَّهِ اللَّهُ أَكْبَرَ لَا إِلَهَ إِلَّا اللَّهَ - (আলহামদু লিল্লাহি আল্লাহু আকবার, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ।) অর্থ সমস্ত প্রশংসা আল্লাহরই জন্য। আল্লাহ সবচেয়ে বড়। আল্লাহ ব্যতীত কোন মা'বুদ নেই। * তারপর আস্তে দুরুদ শরীফ পাঠ করে নিজের জন্য এবং সকলের জন্য দুয়া করুন। এটাও দুয়া কবুল হওয়ার স্থান। * সায়ীর নিয়ত করে নেয়াও উত্তম। * অতঃপর দুয়া কালাম পাঠ করতে করতে মারওয়ার দিকে অগ্রসর হোন। যথাসম্ভব মধ্যবর্তী জায়গা দিয়ে সায়ি করার চেষ্টা করবেন। স্বাভাবিক গতিতে চলতে থাকুন। মাঝখানে সবুজ দুই স্তম্ভনজরে পড়বে, এই স্তম্ভদ্বয়ের মধ্যবর্তী স্থানটুকু পুরুষদের জন্য কিছুটা দ্রুত গতিতে চলা সুন্নাত-একেবারে দৌড়ে নয়। মহিলাগণ এখানেও স্বাভাবিক গতিতে চলবেন। সবুজ দুই স্তম্ভের মাঝখান পার হওয়ার সময় নিম্নোক্ত দুয়া পড়ুন- رَبِّ اغْفِرْ وَارْحَمُ أَنْتَ الْأَعَزُّ الْأَكْرَمُ - (রব্বিগিফ্ফর ওয়ারহাম আন্তাল আ'আযযুল আক্রম।) অর্থ হে আমার রব, তুমি ক্ষমা কর এবং রহমত দান কর, তুমিতো সবচেয়ে বেশী মর্যাদাশালী। সবচেয়ে বড় মেহেরবান! ভিড়ের কারণে দ্রুত চলা সম্ভব না হলে ভিড় কমার অপেক্ষা করবেন। এই মধ্যবর্তী স্থানটুকু পার হওয়ার পর আবার স্বাভাবিক গতিতে চলতে চলতে মারওয়া পাহাড়ে পৌঁছানো। মারওয়া পাহাড়ের সামান্য উঁচুতে উঠে কা'বামুখী হয়ে পূর্বের ন্যায় হাত উঠিয়ে তিনবার নিম্নোক্ত দুয়া পড়ুন এবং অন্যান্য দুয়া করুন- الْحَمْدُ لِلَّهِ اللَّهُ أَكْبَرُ لَا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ (আলহামদু লিল্লাহি আল্লাহু আকবার, লা ইলাহাহা ইল্লাল্লাহ।) অর্থ সমস্ত প্রশংসা আল্লাহরই জন্য। আল্লাহ সবচেয়ে বড়। আল্লাহ ব্যতীত কোন মা'বুদ নেই। * পুরুষদের ভিড় হলে মহিলাগণ উঁচুতে উঠবেন না। * এই মারওয়া পাহাড়েও বেশী উপরে উঠা নিষেধ। * সাফা থেকে এই মারওয়া পর্যন্ত আপনার এক চক্কর হয়ে গেল। আবার এখান থেকে সাফা পর্যন্ত পূর্বের নিয়মে যাবেন তাতে দ্বিতীয় চক্কর হয়ে যাবে। এভাবে সাত চক্কর দিবেন, তাতে মারওয়ার উপর এসে আপনার সপ্তম চক্কর শেষ হবে। সাফা থেকে আবার সাফা পর্যন্ত এক চক্কর হিসেব করবেন না, তাতে চৌদ্দ চক্কর হয়ে যাবে- এটা ভুল। * সায়ীর চক্কর কয়টা হল এ নিয়ে সন্দেহ হলে ক ধারে নিয়ে বাকিটা পূর্ণ করতে হবে। * উপরে দ্বিতীয় তলায় এবং ছাদেও সায়ীর জন্য ব্যবস্থা রয়েছে, সেখানেও সায়ি করা যেতে পারে। * সায়ীর সপ্তম চক্কর শেষ হওয়ার পর মসজিদে হারামের ভিতর এসে দুই রাকাত নফল নামাজ পড়া মোস্তাহাব, যদি মাকরুহ ওয়াক্ত না হয়। এ পর্যন্ত আপনার উমরার সায়ীর কার্যাবলী শেষ হল।
তামাত্তু হজ্জের ৪ নাম্বার কাজ হল হলক বা কসর করা। মাথা মুণ্ডানোকে বলা হয় 'হলক' এবং চুল ছাঁটাকে বলা হয় 'কসর'। নিম্নে মাথা মুণ্ডানো ও চুল ছাঁটার বিস্তারিত মাসায়েল বর্ণনা করা হল। মাথা মুণ্ডন করা বা চুল ছাঁটার মাসায়েল * এহরাম খোলার জন্য মাথা মুণ্ডানো বা চুল ছাঁটা ওয়াজিব। চুল ছাঁটার চেয়ে মাথা মুণ্ডানো উত্তম। তবে মহিলাদের জন্য চুল মুণ্ডানো নয় বরং শুধু চুল ছাঁটারই বিধান। * মাথার কম পক্ষে এক চতুর্থাংশ চুল মুন্ডালে বা ছাঁটালে ওয়াজিব আদায় হয়ে যাবে তবে তা মাকরুহ তাহরীমী। বরং পুরো মাথা মুণ্ডানো বা পুরো মাথার চুল ছাঁটাই মোস্তাহাব বা উত্তম। * চুল ছাঁটার ক্ষেত্রে চুলের লম্বার দিক থেকে আঙ্গুলের এক কড়া পরিমাণ ছাঁটা জরুরি; সাবধানতার জন্য একটু বেশী ছেঁটে নিতে হবে। পুরুষের চুল যদি এত ছোট হয় যে, আঙ্গুলের এক কড়া পরিমাণ ছাঁটা যায় না তাহলে মুণ্ডানো জরুরি। মাথায় চুল একেবারে না থাকলে শুধু ক্ষুর বা ব্লেড চালিয়ে নিতে হবে। * মাথা মুণ্ডানো বা চুল ছাঁটার সময় কেবলামুখী হয়ে বসে নিজের ডান দিক থেকে মুণ্ডানো বা ছাঁটা শুরু করতে বা করাতে পারলে উত্তম। * নাপিত দ্বারা বা নিজেই নিজের চুল মুণ্ডানো বা ছাঁটা যায়। আপনার মত যার এখন মাথা মুন্ডিয়ে বা চুল ছেঁটে হালাল হওয়ার মুহূর্ত, তার দ্বারাও মুণ্ডানো বা ছাঁটানো যায়। * হলক বা কছর করা হলেই এহরাম শেষ হয়ে যাবে। এখন এহরামের পোশাক খোলা যাবে এবং এহরামের অবস্থায় যা যা নিষিদ্ধ ছিল তা জায়েয হয়ে যাবে। এ পর্যন্ত আপনার উমরার কাজ শেষ হল। বিঃ দ্রঃ সামনে ৮ই যিলহজ্জ থেকে হজ্জের কাজ শুরু হবে। এখন থেকে ৮ই যিলহজ্জ পর্যন্ত আপনার হাতে প্রচুর সময় থাকলে এবং মদীনা যিয়ারত না করে থাকলে আপনি মদীনা শরীফ যেতে পারেন। মদীনা শরীফে যিয়ারতের কাজ শেষ করে মক্কার দিকে রওয়ানা হওয়ার সময় হজ্জের জন্য এহরাম বেধে আসবেন। এটাই উত্তম। আর যদি উমরার এহরাম বেধে আসতে চান (বিশেষতঃ হজ্জের সময় দূরে থাকলে এটাও করতে পারেন।) তাও করতে পারেন। মদীনা থেকে মক্কা শরীফ গমনকারীদের মীকাত যেহেতু যুলহুলাইফা, তাই যুলহুলাইফা নামক স্থান (বর্তমান নাম "বীরে আলী") থেকে বা মদীনায় থেকেই এহরাম বেধে মক্কা শরীফ রওয়ানা হবেন। উমরার এহরাম হলে উমরা শেষ করে হালাল হয়ে যাবেন। তারপর মিনায় রওয়ানা হওয়ার পূর্বে আবার হজ্জের জন্য এহরাম বাধবেন। আর যদি তামাত্তু হজ্জের উমরা শেষ করার পর মদীনা যাওয়া না হয়, তাহলে হজ্জের পূর্বে যে কয়দিন সময় থাকে যত বেশী সম্ভব নফল তওয়াফ করতে থাকুন। মসজিদে হারামে জামাতের সাথে নামায আদায় করতে থাকুন। হাদীছ শরীফে মসজিদে হারামে ফরয নামায জামাতের সাথে পড়লে এক লক্ষ গুণ ছওয়াবের ফযীলত বর্ণিত হয়েছে। হযরত জাবের (রাঃ) থেকে বর্ণিত- রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, صَلَاةٌ فِي الْمَسْجِدِ الْحَرَامِ أَفْضَلُ مِنْ مِئَةِ أَلْفِ صَلَاةٍ فِيمَا سِوَاهُ - ابن ماجة - قال في فتح الباري : رجاله ثقات - وقال البوصری : استاد حدیث خابر صحیح ) অর্থাৎ, মসজিদে হারামে এক নামায (মসজিদে নববী ব্যতীত) অন্য মসজিদে এক লক্ষ নামাযের চেয়ে বেশী ফযীলতপূর্ণ। (ইবনে মাজা) উল্লেখ্য- এ হাদীছে মসজিদে হারামে নামায পড়লে এক লক্ষের যে ফযীলত বর্ণিত হয়েছে, তা পুরুষদের বেলায়ই প্রযোজ্য। হাদীছ শরীফে মহিলাদেরকে ঘরে নামায পড়ার জন্যই উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে। মহিলাদের জন্য ঘরে নামায পড়ার মধ্যেই ফযীলত নিহিত। অতএব মহিলাগণ আপন বাসস্থানেই একা একা নামায পড়ে নিবেন। একান্তই কখনও মসজিদে জামাতে শরীক হলে পুরুষদের থেকে পৃথক হয়ে মহিলাদের জন্য নির্ধারিত স্থানে মহিলাদের সাথে মিলে নামায পড়বেন। অনেক সময় দেখা যায় মহিলাগণ পুরুষদের কাতারে দাঁড়িয়ে জামাতে নামায আদায় করেন। এরূপ করা কোনমতেই দুরস্ত নয়। মসজিদে হারামে কা'বা শরীফের দিকে ভক্তির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকাও ছওয়াবের কাজ। এতে বিশ রহমত নাযিল হওয়ার কথা হাদীছ শরীফে বর্ণিত হয়েছে। স্বাস্থ্যের প্রতি খেয়াল রাখাও অত্যাবশ্যক। কারণ, সামনে হজ্জের দিনগুলোতে কঠিন পরিশ্রমের কাজ রয়েছে। মহিলাগণ পর্দার হুকুম বজায় রেখে সম্ভব হলে নফল তওয়াফ করবেন। পুরুষের ভীড়ে ধাক্কাধাক্কির মত অবস্থা থাকলে নফল তওয়াফ করা থেকে বিরত থাকবেন। হজরে আসওয়াদে সরাসরি চুমু দেয়া থেকেও বিরত থাকবেন। কারণ এতে পর্দা বিধান লংঘন হবে এবং শালীনতা বর্জিত হবে। এর জন্য গভীর রাত বা পুরুষের ভীড়মুক্ত সময়ের সুযোগ নেয়া যেতে পারে। * নফল তওয়াফে রমল ও এজতেবা নেই এবং তওয়াফের পর সায়ীও নেই। তবে তওয়াফের পর দুই রাকআত সালাতুত্তাওয়াফ নামায পড়তে হবে। * নিজের জন্য, রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জন্য বা জীবিত কিংবা মৃত পিতা-মাতা, আত্মীয়-স্বজন, উস্তাদ, পীর বুযুর্গ বা যে কোন ব্যক্তিকে ছওয়াব পৌঁছানোর জন্য নফল তওয়াফ করা যেতে পারে। তওয়াফের অন্যান্য মাসায়েল পূর্বে বর্ণিত হয়েছে। * তামাত্তু হজ্জকারী ব্যক্তি ওয়াজিব উমরা থেকে ফারেগ হওয়ার পর হজ্জের পূর্বে নফল উমরাও করতে পারেন। তাই আপনি চাইলে নফল উমরাও করতে পারেন। তবে নফল উমরার চেয়ে নফল তওয়াফ করা অধিক উত্তম। * বৎসরের পাঁচ দিন ব্যতীত যে কোন দিন উমরার এহরাম বাধা যায়। উক্ত পাঁচ দিন হল ৯ই যিলহজ্জ থেকে ১৩ই যিলহজ্জ। * নফল উমরার এহরাম বাধার জন্য 'তানয়ীম (মসজিদে আয়েশা) গিয়ে এহরাম বেধে আসবেন। জোরানা নামক স্থানে গিয়েও এহরাম বেধে আসতে পারেন। তামাত্তু হজ্জের উমরা যেভাবে করেছেন, নফল উমরাও সেভাবে করবেন। অর্থাৎ, পূর্বের নিয়মে তওয়াফ সায়ী করার পর হলক বা কছর করে হালাল হয়ে যাবেন।
তামাত্তু হজ্জের ৫ নাম্বার কাজ হল হজ্জের এহরাম বাধা। নিম্নে এ সম্বন্ধে মাসায়েল বর্ণনা করা হল। * ৭ই যিলহজ্জ জোহর বা জুমুআর নামাযের পর হারাম শরীফে হজ্জের নিময়মাবলীর উপর খুতবা দেয়া হলে তা শুনুন এবং মর্ম বুঝতে না পারলে কারও থেকে বুঝে নিন। * ৮ই যিলহজ্জ থেকে হজ্জের প্রস্তুতি শুরু হবে। হজ্জের জন্য আপনাকে এহরাম বাধতে হবে। এহরাম বাধার নিয়ত পূর্বে বর্ণিত হয়েছে। মসজিদে হারামে গিয়ে এই এহরাম বাধা মোস্তাহাব। মহিলাগণ বাসায় এহরাম বাধলেও মোস্তাহাব আদায় হবে। এহরাম বেধে মিনায় যেতে হবে। যদি উমরা থেকে ফারেগ হয়ে মদীনা শরীফে গিয়ে থাকেন এবং মদীনা শরীফ থেকে হজের জন্য এহরাম বেধে এসে থাকেন, তাহলে এখন আর এহরাম বাধতে হবেনা। * আজকাল ৭ই যিলহজ্জ দিবাগত রাতেই মুআল্লিমের গাড়ীতে হাজীদেরকে মিনায় পৌঁছানোর কাজ শুরু হয়। তাই যারা মুআল্লিমের গাড়ীতে মিনার যাবেন তারা ৭ই তারিখেই এহরাম বেধে নিবেন। এহরামের পর তালবিয়া শুরু হবে। * ১০ থেকে ১২ই যিলহজ্জ যে তওয়াফে যিয়ারত বা ফরফ তওয়াফ করা হবে সেই তওয়াফের পর (ওয়াজিব) সায়ী করার সময় প্রচণ্ড ভীড় হতে পারে, সেই ভীড়ে সায়ী করতে না চাইলে এখন মিনায় রওয়ানা দেয়ার পূর্বে একটি নফল তওয়াফ করে সেই সায়ী অগ্রিম করে নিতে পারেন। এরূপ করলে এই নফল তওয়াফে পুরুষদেরকে রমল ও এজতেবাও করতে হবে। নিয়মমত তওয়াফ শেষ করার পর দুই রাকআত সালাতুত্তাওয়াফ নামায পড়বেন, তারপর সায়ী করবেন। তবে তামাত্তু হজ্জকারীর জন্য তওয়াফে যিয়ারতের সায়ী অগ্রিম না করে তওয়াফে যিয়ারতের পরেই করা উত্তম।
তামাত্তু হজ্জের ৬ নাম্বার কাজ হল মিনায় অবস্থান করা। ৮ই যিলহজ্জ যোহর থেকে ৯ই যিলহজ্জ ফজর পর্যন্ত মিনার অবস্থান ও পাঁচ ওয়াক্ত নামায সেখানে আদায় করা সুন্নাত। নিম্নে মিনায় গমন ও অবস্থান সম্পর্কে মাসায়েল এবং নিয়মনীতি বর্ণনা করা হল। মিনায় গমন ও অবস্থান সম্পর্কে মাসায়েল। * ৮ই যিলহজ্জের যোহর, আসর মাগরিব, ইশা এবং ৯ই যিলহজ্জের ফজর সর্বমোট এই পাঁচ ওয়াক্ত নামায মিনায় পড়া মোস্তাহাব এবং এ সময়ে মিনায় অবস্থান করা সুন্নাত। * ৮ই যিলহজ্জের পূর্বে যদি আপনি মক্কা শরীফে মুকীম হিসেবে অন্ততঃ ১৫ দিন অবস্থান করে থাকেন তাহলে মিনায়, এমনিভাবে আরাফায় এবং মুযদালিফায়ও পুরো নামায পড়বেন, আর তা না হলে এসব স্থানেও কছরের বিধান চলবে। অর্থাৎ, যোহর, আসর ও ইশার ফরয নামায চার রাকআতের স্থলে দুই রাকআত করে পড়বেন। আর সময়ের ব্যস্ততা না থাকলে সুন্নত পুরোপুরী পড়বেন।
তামাত্তু হজ্জের ৭ নাম্বার কাজ হল ৯ই যিলহজ্জ উকূফে আরাফা করা তথা আরাফায় অবস্থান করা। এটা হজ্জের প্রধানতম ফরয। নিম্নে উকূফে আরাফা তথা আরাফায় অবস্থানের মাসায়েল ও নিয়ম কানুন বর্ণনা করা হল। উকুফে আরাফার মাসায়েলঃ ৯ই যিলহজ্জ পূর্বের বেশ উজালা হওয়ার পর ফজরের নামায পড়ে সূর্যোদয়ের সামান্য কিছু পর আরাফার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হতে হবে। এখানে আরও একটি মাসআলা স্মরণ রাখতে হবে যে, ৯ই যিলহজ্জ থেকে ১৩ই যিলহজ্জের আসর পর্যন্ত সর্বমোট ২৩ (তেইশ) ওয়াক্ত ফরয নামাযের পর তাকবীরে তাশরীক বলা ওয়াজিব। * এই ২৩ ওয়াক্ত ফরয নামাযের পর প্রথম তাকবীরে তাশরীক বলবেন তারপর তালবিয়া পড়বেন। জামা'আতে নামায হোক বা একাকী সর্বাবস্থায় তাকবীরে তাশরীক বলতে হবে। * তাকবীরে তাশরীক এই- اللهُ أَكْبَرَ الله أكبر لا إله إلا الله والله أكبر الله (আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার ওয়া লিল্লাহিল হামদ।) * এই তাকবীর জোর আওয়াজে বলা ওয়াজিব। নারীদের জন্য এই তাকবীর জোর আওয়াজে নয় বরং নিম্নস্বরে বলা ওয়াজিব। * নামাযের সালাম ফিরানোর সাথে সাথে এই তাকবীর বলতে হবে। ইমাম বলতে ভুলে গেলে মুক্তাদীগণ সাথে সাথে বলবে-ইমামের বলার অপেক্ষা করবে না। * তাকবীরে তাশরীক একবার বলা ওয়াজিব। তিনবার বলা সুন্নাত নয়। তিনবার বলা সুন্নাতের মত অনুযায়ী ফতুয়া দেয়া হয় না। (فتاوی رقیه حد/۳) ۱ * আরাফায় যাওয়ার পথে তালবিয়া পড়তে পড়তে, দুআ ও যিকির করতে করতে, অত্যন্ত খুশু-খুযূর সাথে তথা বিনয়ের সাথে চলতে থাকুন। * আরাফার ময়দানে অবস্থিত জাবালে রহমতের উপর দৃষ্টি পড়তেই এই দুআ পড়া মোস্তাহার- اَللهُمَّ إِنِّى تَوَجَّهْتُ إِلَيْكَ وَعَلَيْكَ تَوَكَّلْتُ وَوَجْهَكَ أَرَدْتُ ، اَللَّهُمَّ اغْفِرْ لِي وَتُبُ عَلَى ، وَاعْطِنِى سُؤْلِي ، وَوَجْهُ لِيَ الْخَيْرَ حَيْثُ تَوَجَّهْتُ ، سُبْحَانَ اللهِ وَالْحَمْدُ لِلَّهِ وَلَا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ وَاللَّهُ أَكْبَرُ - (আল্লাহুম্মা ইন্নী তাওয়াজ্জাহতু ইলাইকা ওয়া আলাইকা তাওয়াক্কালতু ওয়া ওয়াজহাকা আরদত্তু , আল্লাহুম্মাগফিরলী ওয়াতুব আলাইয়্যা ওয়া আ'তিনী সু'লী ওয়া ওয়াজ্জিহ লিয়াল খইরা হাইছু তাওয়াজ্জাহতু, সুবহানাল্লাহি ওয়াল হামদু লিল্লাহি ওয়া লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াল্লাহু আকবার।) অর্থঃ হে আল্লাহ! আমি তোমার প্রতি মনোযোগী হলাম, তোমারই উপর তাওয়াক্কুল করলাম এবং তোমারই সন্তুষ্টির এরাদা করলাম। হে আল্লাহ! আমাকে ক্ষমা কর, আমার তওবা কবুল কর, আমি যা আবেদন করি তা আমাকে দান কর এবং আমি যেদিকে মুখী হই আমার জন্য সেদিকেই কল্যাণ রেখ। আমি আল্লাহর পবিত্রতা বর্ণনা করছি। সমস্ত প্রশংসা আল্লাহরই জন্য এবং আল্লাহ ব্যতীত কোন মা'বুদ নেই। আর আল্লাহ সবচেয়ে বড়। * এ সময় দুআ করুন। এটা দুআ কবুল হওয়ার সময়। * তারপর বেশী বেশী তালবিয়া পড়তে পড়তে আরাফার ময়দানে প্রবেশ করুন। আরাফার ময়দানের চতুর্দিকে সীমানা নির্ধারণী সাইনবোর্ড দেয়া রয়েছে, যা দেখে আরাফার ময়দান চেনা সহজ হয়। * আরাফার ময়দানে জাবালে রহমত পাহাড়ের কাছাকাছি অবস্থান করতে পারলে ভাল, তবে পাহাড়ে আরোহণ করবেন না। বানে উরানা (আরাফার ময়দানের একটি অংশের নাম, যার কিছু অংশ মসজিদে নামিয়ার ভিতর কেবলার দিকে পড়েছে।) ব্যতীত আরাফার যে কোন স্থানে অবস্থান করা যায়। * সূর্য ঢলা থেকে উকূফে আরাফা শুরু এবং সূর্য অস্ত গেলে উকুফে আরাফা শেষ হবে। কোন কারণ বশতঃ কেউ সূর্য অস্ত যাওয়া পর্যন্ত আরাফায় পৌঁছতে অপারগ হলে ১০ তারিখের সুবহে সাদেক পর্যন্ত আরাফায় পৌঁছলেও হজ্জ আদায় হয়ে যাবে। তবে দম দিতে হবে। * আরাফায় পৌঁছার পর তালবিয়া, দুআ ও দুরূদ শরীফ পাঠ বেশী বেশী করতে থাকবেন। সূর্য ঢলার পূর্বেই খানা পিনা থেকে ফারেগ হয়ে যাবেন। সূর্য ঢলার পর গোসল করা উত্তম, না পারলে উযূ করে নিবেন। * যারা তাবুতে নামায পড়বেন তারা যোহরের ওয়াক্তে যোহর এবং আসরের ওয়াক্তে আসরের নামায পড়বেন। প্রত্যেক নামাযের জন্য ভিন্ন ভিন্ন আযান ও ইকামত হবে।১ উল্লেখ্য- মসজিদে নামিরায় যোহরের এবং আসরের নামায একত্রে যোহরের ওয়াক্তে পড়ে নেয়া হয়, কতিপয় শর্ত সাপেক্ষে এরূপ করা জায়েয। তবে আমাদের জানামতে আজকাল মিনা, আরাফা ও মুযদালিফায় সৌদি সরকার কর্তৃক নির্ধারিত ইমাম মুকীম হওয়া সত্ত্বেও কসর পড়ে থাকেন, হানাফী মাযহাব অনুযায়ী এরূপ করা সহীহ নয়। অতএব এরূপ অবস্থায় হানাফী মাযহাব অনুসারীদের নামায তাদের পিছনে সহীহ হবে না। নারীগণ পুরুষদের থেকে আলাদা হয়ে তাবুর মধ্যে যোহরের ওয়াক্তে যোহর এবং আসরের ওয়াক্তে আসরের নামায পড়ে নিবেন। * উকূফে আরাফার সময় যথাসম্ভব দাঁড়িয়ে থাকা এবং দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তালবিয়া, তাসবীহ-তাহলীল, দুরূদ পাঠ ও দুআ করতে থাকা মোস্তাহাব। না পারলে বসে বসে বা শুয়ে এগুলো করলেও চলবে। ঘুম এসে গেলেও অসুবিধা নেই, তবে বিনা ওজরে নিদ্রা যাওয়া মাকরূহ। )معلم الحجاج( ১. হাদীছে এসেছে, হযরত ইব্রাহীম নখী থেকে বর্ণিত- اذا صليت في رحلك بعرفة فصل كل واحدة منهما لوقتها واجعل لكل واحدة منهما اذانا واقامة . (مصنف ابن ابي شيبة حديث رقم - ١٤٢٣٥) অর্থাৎ, যখন তুমি আরাফায় তোমার তাবুতে নামায পড়বে, তখন প্রত্যেক নামাযকে তার নির্দিষ্ট ওয়াক্তে পড়বে এবং প্রত্যেক নামাযের জন্য ভিন্ন ভিন্ন আযান ইকামত দিবে। (মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা, হাদীছ নং ১৪২৩৫)। এক রেওয়ায়েতে এসেছে- যে ব্যক্তি আরাফার দিন সূর্য ঢলার পর কেবলামুখী হয়ে নিম্নোক্ত দুআগুলো পাঠ করবে, আল্লাহ তাআলা তাকে ক্ষমা করে দিবেন, সে নিজের জন্য এমনকি সমস্ত আরাফাবাসীর জন্য সুপারিশ করলেও তার সুপারিশ কবুল করা হবে। ১০০ বার لَا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ وَحْدَهُ لَا شَرِيكَ لَهُ لَهُ الْمُلْكُ وَلَهُ الْحَمْدُ وَهُوَ عَلَى كُلِّ شَيْ قَدِيرٌ . অতঃপর ১০০ বার সূরা ইখলাস, অতঃপর ১০০ বার اللَّهُمَّ صَلِّ عَلَى مُحَمَّدٍ وَعَلَى آلِ مُحَمَّدٍ كَمَا صَلَّيْتَ عَلَى إِبْرَاهِيمَ وَعَلَى آلِ إِبْرَاهِيمَ إِنَّكَ حَمِيدٌ مَّجِيدٌ وَعَلَيْنَا مَعَهُمْ . * সূর্যাস্তের পূর্বে কোন ক্রমেই আরাফা ময়দানের সীমানা ত্যাগ করা যাবে না। তাহলে দম দিতে হবে। দম সম্পর্কে জানার জন্য দেখুন ১৭৮-১৮৫ পৃষ্ঠা। * সূর্য অস্ত যাওয়ার পর মাগরিবের নামায না পড়ে যথাসম্ভব বিলম্ব না করেই মুযদালিফার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হতে হবে। বিনা ওজরে রওনা দিতে বিলম্ব করা মাকরূহ। এই মাগরিবের নামায মুযদালিফায় গিয়ে ইশার ওয়াজে পড়তে হবে। বি:দ্র: قي في شعب الايمان برقم ٤٠٧٤ وقال : هذا متن غريب وليس ذ في اساده من
তামাত্তু হজ্জের ৮ নাম্বার কাজ হল ৯ই যিলহজ্জ দিবাগত রাত মুযদালিফায় অবস্থান করা। এই অবস্থান ওয়াজিব। নারীদের জন্য মুযদালিফায় অবস্থান ওয়াজিব নয়, তবে নারীগণ হিম্মত করে মুযদালিফায় থাকবেন, এ রাত অনেক ফযীলতের রাত। তাছাড়া নারীর মাহরাম পুরুষ যেহেতু এখানে থাকবেন, তাই চলে যাওয়ার মত সঙ্গী না পেলে তার সাথে তাকেও এখানে থাকতেই হবে। নিম্নে মুযদালিফায় অবস্থান সম্পর্কে বিস্তারিত বর্ণনা পেশ করা হল। মুযদালিফায় গমন ও উকূফে মুযদালিফার মাসায়েলঃ * ৯ই যিলহজ্জ সূর্য অস্ত যাওয়ার পর আরাফায় বা রাস্তায় কোথাও মাগরিবের নামায না পড়ে সোজা মুযদালিফার দিকে চলুন। তালবিয়া, তাকবীর, দুরূদ ও দুআ পাঠ করতে করতে চলুন। * ধাক্কাধাক্কিতে কারও কষ্ট হওয়ার আশংকা না থাকলে কিছু দ্রমত চলা উত্তম। গাড়ীতেও যাওয়া যায়। * মুযদালেফার নিকটবর্তী যেয়ে গাড়ীতে এসে থাকলে সম্ভব হলে গাড়ী থেকে নেমে পায়ে হেঁটে মুযদালিফায় প্রবেশ করা মোস্তাহাব। সম্ভব হলে মুযদালিফায় প্রবেশের পূর্বে গোসল করে নেয়া মোস্তাহাব। * মুযদালিফায় পৌঁছে ইশার ওয়াক্ত হলে এক আযান ও এক ইকামতে প্রথমে মাগরিবের ফরয তারপর ইশার ফরয পড়ুন। তারপর মাগরিবের সুন্নাত, তারপর ইশার সুন্নাত, তারপর বিতর পড়ুন। (প্রত্যেক ফরয নামাযের পর তাকবীরে তাশরীক পড়ার কথাও স্মরণ রাখবেন) * এখানে মাগরিবের নামায ইশার ওয়াক্তে পড়া হলেও কাযার নিয়ত নয় বরং ওয়াক্তিয়ার নিয়ত করবেন। এখানে উভয় ওয়াক্তের নামায জামা'আত সহকারে পড়া উত্তম। * মাগরিব ও ইশার নামায পড়ার পর সুবহে সাদেক পর্যন্ত মুযদালিফায় অবস্থান করা সুন্নাতে মুয়াক্কাদা। এ রাতে জাগরণ করা এবং নামায, তিলাওয়াত, দুআ ইত্যাদিতে মশগুল থাকা মোস্তাহাব। কারও কারও মতে এ রাত শবে কদর অপেক্ষাও শ্রেষ্ঠ। * সুবহে সাদেক থেকে সূর্য উদয় হওয়া পর্যন্ত অন্ততঃ কিছু সময় মুযদালিফায় অবস্থান করা ওয়াজিব। এই সময়ের মধ্যে মুযদালিফায় পৌঁছতে না পারলে দম দিতে হবে। গাড়ি এই সময়ের মধ্যে পৌঁছতে না পারার সম্ভাবনা দেখা দিলে গাড়ি থেকে নেমে হেঁটে এই সময়ের মধ্যে মুযদালিফায় প্রবেশ করুন। * অনেকে তাড়াতাড়ি মিনায় গিয়ে ভীড় হওয়ার পূর্বেই কংকর মারার চিন্তায় সুবহে সাদেক হওয়ার আগেই অর্থাৎ, ফজরের ওয়াক্ত হওয়ার আগেই মুযদালিফা ত্যাগ করে মিনায় চলে যায়, তাদের উকূফে মুযদালিফার ওয়াজিব ছুটে যায়। এই ওয়াজিব ছুটে যাওয়ার দরুণ তাদেরকে দম দিতে হবে। দম সম্পর্কে জানার জন্য দেখুন ১৭৮-১৮৫ পৃষ্ঠা। * সুবহে সাদেক হওয়ার পর উকূফে মুযদালিফার জন্য গোসল করা মোস্তাহাব। * সুবহে সাদেক হওয়ার পর আওয়াল ওয়াক্তে ফজরের নামায পড়ে নেয়া উত্তম এবং জামাআত সহকারে পড়া উত্তম। নামাযের পর যিকির এস্তেগফার ও মুনাজাতে মশগুল থাকবেন। সূর্যোদয়ের ২/৪ মিনিট পূর্বে মুযদালিফা থেকে মিনার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হতে হবে। * সুবহে সাদেকের পূর্বে মুযদালিফা ত্যাগ করলে ওয়াজিব তরক হওয়ার কারণে গোনাহ হবে এবং দমও দিতে হবে। দম সম্পর্কে জানার জন্য দেখুন ১৭৮-১৮৫ পৃষ্ঠা। * মুযদালিফা থেকে ছোলা-বুটের সমান ৭০টি কংকর সংগ্রহ করে নিয়ে যাবেন, এগুলো মিনায় জামরাতে নিক্ষেপ করা হবে। এ কংকর মিনা থেকেও সংগ্রহ করা যায়, তবে কংকর নিক্ষেপের জায়গা থেকে নেয়া নিষেধ।
তামাত্তু হজ্জের ৯ নাম্বার কাজ হল ১০ই যিলহজ্জ থেকে ১২ই যিলহজ্জ পর্যন্ত কংকর নিক্ষেপ করা। এই কংকর নিক্ষেপ করা ওয়াজিব। নিম্নে কংকর নিক্ষেপের মাসায়েল বর্ণনা করা হল। কংকর নিক্ষেপের মাসায়েলঃ * ১০ই যিলহজ্জ সূর্যোদয়ের কিছু পূর্বে মুযদালিফা থেকে রওনা হয়ে মিনায় এসে সামানপত্র সাথে থাকলে তা হেফাজতে রেখে বড় জামরায় বা বড় শয়তানে ৭টি কংকর নিক্ষেপ করতে হবে। বড় জামরা হল তিনটি জামরার মধ্যে মসজিদে খায়ফ থেকে দূরবর্তী এবং মক্কা শরীফের দিকে নিকটবর্তী জামরা। * ১০ই যিলহজ্জ, ১১ই যিলহজ্জ ও ১২ই যিলহজ্জ এই তিন দিন কংকর নিক্ষেপ করা ওয়াজিব। * ১০ই যিলহজ্জ কংকর নিক্ষেপ করার সুন্নাত সময় হল সূর্যোদয় থেকে সূর্য চলার পূর্ব পর্যন্ত। আর সূর্য চলার পর থেকে সূর্য অস্ত যাওয়া পর্যন্ত হল জায়েয সময় এবং সূর্যাস্ত যাওয়ার পর থেকে পরবর্তী সুবহে সাদেক পর্যন্ত মাকরূহ সময়। তবে দূর্বল, মাযূর ও মহিলাদের জন্য মাকরূহ নয়। প্রচণ্ড ভীড়ের কারণে দুর্ঘটনার আশংকা থাকলে এটাকে ওজর গণ্য করে সূর্য অস্ত যাওয়ার পর কংকর নিক্ষেপ করা যেতে পারে। নারীদের জন্য যেহেতু ওজর না থাকলেও রাতের বেলায় কংকর নিক্ষেপ করা মাকরূহ নয়। বরং রাতের বেলায় পুরুষদের সাথে ধাক্কাধাক্কি ও জটিলতার সম্মুখীন হতে হয়না। তাই নারীদের জন্য রাতের বেলায়ই কংকর নিক্ষেপ করা উত্তম। * কংকর নিক্ষেপের মোস্তাহাব তরীকা হল: কংকর নিক্ষেপের সময় যে স্তম্ভে কংকর নিক্ষেপ করা হবে তার দক্ষিণ দিকে দাঁড়িয়ে মিনাকে ডান দিকে এবং কা'বা শরীফেকে বাম দিকে রেখে স্তম্ভের অন্ততঃ পাঁচ হাত দূরে দাঁড়িয়ে (এর চেয়ে কাছে দাঁড়িয়ে কংকর মারা মাকরূহ) ডান হাতের শাহাদাত ও বৃদ্ধাঙ্গুলী দ্বারা এক একটি কংকর ধরে হাত এতটুকু উঁচু করে নিক্ষেপ করবেন যেন বগল দেখা যায়। প্রতিটি কংকর নিক্ষেপের সময় 'বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার' বলবেন। পারলে আরও কয়েকটি বাক্য যোগে নিম্নোক্ত দুআ পড়বেন। بِسمِ اللهِ اَللهُ اَكْبَرُ ، رَغَمًا لِلشَّيْطَانِ ، وَرِضَى لِلرَّحْمَنِ ، اللَّهُمَّ اجْعَلُهُ حَبًّا مَّبْرُورًا ، وَذَنْبًا مَّغْفُورًا ، وَسَعيًا مَشْكُورًا - (বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার, রগমান লিশ শাইতনি, ওয়া রিযান্ লিরহমানি, আল্লাহুম্মাজ 'আল্লহু হাজ্জাম মাবরুরো, ওয়া যামবাম মাগফুরো, ওয়া সা'ইয়াম মাসকুরো। ) অর্থ: মহান আল্লাহর নামে কংকর মারছি। শয়তানকে অসন্তুষ্ট এবং আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার জন্য এটা করছি। হে আল্লাহ। আমার এই হজ্জ কবুল কর, গোনাহ মাফ কর এবং চেষ্টাকে সাফল্যমন্ডিত কর। * প্রথম কংকর নিক্ষেপের পূর্ব মুহূর্ত থেকে তালবিয়া পড়া বন্ধ করে দিতে হবে। এরপর আর তালবিয়া নেই। * কংকর নিক্ষেপের সময় সতর্ক থাকতে হবে যেন স্তম্ভের নীচের দিকে চারপাশে কিছুটা উঁচু করে দেয়াল দিয়ে যে ঘেরা আছে কংকরটি তার বাইরে না পড়ে বা সজোরে স্তম্ভে লেগে বাইরে ছিটকে না যায়। যে কংকরটি এ ঘেরার মধ্যে না পড়বে সেটি বাদ বলে গণ্য হবে। সেটার বদলে আবার নিক্ষেপ করতে হবে। * উপর থেকে বা যেকোন দিক থেকে কংকর নিক্ষেপ করলেও জায়েয় হবে। ভিড়ের ভয়ে বা কিছুটা কষ্টের ভয়ে অন্যের মাধ্যমে কংকর আদায় হবে না। তাহলে দম দিতে হবে। অন্যের দ্বারা কংকর নিক্ষেপ করানো কেবল তখনই সহীহ হবে, যখন কংকর নিক্ষেপের স্থানে যাওয়ার মত শক্তি সামর্থ্য না থাকে অর্থাৎ, এমন পর্যায়ের অক্ষম হয় যে, শরী'আতের দৃষ্টিতে বসে নামায পড়া তার জন্য জায়েয হয়। এ পর্যায়ের অপারগ ব্যতীত অন্য কারও পক্ষে অপরের দ্বারা কংকর নিক্ষেপ করানোর অনুমতি নেই। * কংকর নিক্ষেপের পর জামরার নিকট বিলম্ব না করেই নিজ স্থানে চলে আসবেন।
তামাত্তু হজ্জের ১০ নাম্বার কাজ হল কুরবানী করা। নিম্নে কুরবানী সম্পর্কে বিস্তারিত মাসায়েল বর্ণনা করা হল। * কংকর নিক্ষেপের পর দমে শোকর বা হজ্জের শোকর স্বরূপ কুরবানী করা ওয়াজিব। কুরবানী নিজে গিয়েও করা যায়, কাউকে পাঠিয়েও করানো যায়। কুরবানী ১০ই যিলহজ্জে বড় জামরায় কংকর নিক্ষেপের পর থেকে ১২ই যিলহজ্জের সূর্য অস্ত যাওয়ার পূর্ব পর্যন্ত করা যায়। ১০ই যিলহজ্জ বড় জামরায় কংকর নিক্ষেপের পূর্বে কুরবানী করা যায় না, করলে দম ওয়াজিব হবে। উল্লেখ্য যে, ৭ বা ৮ তারিখ মিনায় রওনা হওয়ার পূর্বে কেউ যদি মক্কায় ১৫ দিন বা তার বেশী অবস্থানের কারণে মুকীম হয়ে গিয়ে থাকেন এবং তিনি ছাহেবে নেছাব হন, তাহলে হজ্জের কুরবানী ব্যতীত ঈদুল আযহার কুরবানীও তার উপর ওয়াজিব হবে। এমতাবস্থায় তাকে দুটো কুরবানী করতে হবে। এখানে আরও উল্লেখ্য যে, বর্তমানে মক্কা মদীনায় হজ্জের কুরবানীর অর্থ ব্যাংকে জমা নেয়া হয়। আপনার কুরবানীর অর্থ ব্যাংকে জমা দেয়ার ইচ্ছা হলে অবশ্যই কোন বিজ্ঞ আলেমের সাথে মাশওয়ারা করে বিষয়টি সম্পর্কে মাসআলাগত সুবিধা অসুবিধা ভালভাবে বুঝে নিন।
তামাত্তু হজ্জের ১১ নাম্বার কাজ হল হলক বা কছর করা। মাথা মুণ্ডানোকে বলা হয় 'হলক' এবং চুল ছাঁটাকে বলা হয় 'কছর'। * ১০ই যিলহজ্জ কংকর নিক্ষেপ করার পর হলক (মাথা মুণ্ডানো) বা কছর করা (চুল ছাঁটা) ওয়াজিব। * এই হলক বা কছর বড় জামরায় কংকর নিক্ষেপ ও কুরবানী করার পরে করা ওয়াজিব, পূর্বে করা যাবে না, করলে দম দিতে হবে। হলক ও কছর সম্পর্কিত মাসায়েল পূর্বে বর্ণনা করা হয়েছে। * এই হলক বা কছর করার পর এহরামের পোশাক খোলা যাবে এবং এহরামের অবস্থায় যা যা নিষিদ্ধ ছিল তা জায়েয হয়ে যাবে। শুধু তওয়াফে যিয়ারত করার পূর্বে স্ত্রী সম্ভোগ করা হালাল হবে না।
তামাত্তু হজ্জের ১২ নাম্বার কাজ হল তওয়াফে যিয়ারত করা। তওয়াফে যিয়ারত করা ফরয। নিম্নে তওয়াফে যিয়ারত সম্পর্কে বিস্তারিত বর্ণনা পেশ করা হল। তওয়াফে যিয়ারতের মাসায়েলঃ * ১০ই যিলহজ্জ সুবহে সাদেক থেকে ১২ই যিলহজ্জ সূর্য অস্ত যাওয়া পর্যন্ত এই তওয়াফ করা যায়। তার পরে করলে মাকরূহ তাহরীমী হবে এবং দম দিতে হবে। তবে ১০ই যিলহজ্জেই করে নেয়া উত্তম। মহিলাগণ হায়েয নেফাসের অবস্থা হলে পবিত্র হওয়ার পর তওয়াফ করবে, তাতে তাদেরকে দম দিতে হবেনা। তওয়াফের তরীকা ও অন্যান্য মাসায়েল পূর্বে যা বর্ণিত হয়েছে এ তওয়াফের বেলায়ও তা চলবে। এই তওয়াফের পর ওয়াজিব সায়ী করার থাকলে এই তওয়াফে রমল করতে হবে এবং এহরাম না খুলে থাকলে এজতেবাও করতে হবে। আর ওয়াজিব সায়ী করার না থাকলে রমল ও এজতেবা করতে হবে না। মহিলাদের জন্য কোন অবস্থাতেই রমল ও এজতেবা নেই।
.* তামাত্তু হজ্জকারীর জন্য এই সায়ী তওয়াফে যিয়ারতের পরে করা উত্তম। হজ্জের এহরাম বেধে মিনায় রওয়ানা দেয়ার পূর্বে কোন নফল তওয়াফের পর এই সায়ী করে থাকলে তওয়াফে যিয়ারতের পর আর সায়ী করতে হবেনা। তাই তখন তওয়াফে যিয়ারতে রমলও করতে হবেনা। আর নফল তওয়াফের পর এই সায়ী করে না থাকলে রমল থাকবে, তবে তওয়াফে যিয়ারতের পূর্বে এহরামের কাপড় খুলে থাকলে এজতেবা থাকবেনা। মহিলাদের জন্য কোন অবস্থাতেই রমল ও এজতেবা নেই। ১১ ও ১২ যিলহজ্জের কংকর নিক্ষেপঃ * ১১ই যিলহজ্জ পর্যায়ক্রমে ছোট জামরা (সর্ব পূর্বের জামরা) তারপর মধ্যম জামরা, তারপর বড় জামরায় ৭টি করে কংকর নিক্ষেপ করবেন। এই কংকর নিক্ষেপ করা ওয়াজিব। ছোট জামরা ও মধ্যম জামরায় কংকর নিক্ষেপের পর ভীড় থেকে একটু দূরে সরে কেবলামুখী হয়ে সুবহানাল্লাহ, আলহামদুলিল্লাহ, লাইলাহা ইল্লাল্লাহু আল্লাহু আকবার ইত্যাদি পড়বেন এবং দুআ করবেন। তবে বড় জামরায় নিক্ষেপের পর এরূপ করবেন না। * ১১ই যিলহজ্জ কংকর নিক্ষেপের সময় শুরু হবে সূর্য চলার পর থেকে, এর পূর্বে করলে আদায় হবে না। সূর্য চলার পর থেকে সূর্য অস্ত যাওয়া পর্যন্ত হল সুন্নাত সময়, আর সূর্য অস্ত যাওয়ার পর থেকে সুবহে সাদেক পর্যন্ত মাকরূহ সময়। তবে দুর্বল, মা'যূর ও মহিলাদের জন্য মাকরূহ নয়। বরং তাদের জন্য রাতেই কংকর নিক্ষেপ করা উত্তম। কংকর নিক্ষেপের তরীকা ও মাসায়েল পূর্বে বর্ণিত হয়েছে। * ১১ই যিলহজ্জ দিবাগত রাতও মিনায় থাকবেন। * ১২ই যিলহজ্জ তারিখও ১১ই যিলহজ্জের ন্যায় তিন জামরায় কংকর নিক্ষেপ করা ওয়াজিব। অনেকেই ১২ই যিলহজ্জ তারিখে জলদি জলদি মক্কায় ফিরে যাওয়ার জন্য সূর্য চলার পূর্বেই কংকর নিক্ষেপ করে ফেলেন, অথচ এটা না জায়েয। এরূপ করলে পুনরায় সূর্য ঢলার পর তাদেরকে কংকর নিক্ষেপ করতে হবে, নতুবা দম দিতে হবে। * ১২ই যিলহজ্জ কংকর নিক্ষেপ করে মক্কায় ফিরে যাওয়া জায়েয, তবে ১৩ই যিলহজ্জ কংকর নিক্ষেপ করে তারপর মক্কায় ফিরে যাওয়া উত্তম। ১২ই যিলহজ্জ কংকর নিক্ষেপ করে মক্কায় ফিরতে চাইলে সূর্যাস্তের পূর্বেই মিনা থেকে বের হয়ে যাবেন। সূর্যাস্তের পর ফিরা মাকরূহ। তবে দূর্বল, মা'যর ও মহিলাগণ সুবহে সাদেকের পূর্ব পর্যন্ত মাকরূহ হওয়া ছাড়াই ফিরতে পারেন। আর যদি মিনার সীমানাতেই সুবহে সাদেক হয়ে যায়, তাহলে সকলেরই জন্যে ১৩ তারিখেও তিন জামরায় কংকর নিক্ষেপ করা ওয়াজিব হয়ে যায়- না করলে দম দিতে হবে। * ১৩ ই যিলহজ্জ যদি সূর্য ঢলার পূর্বেই কংকর নিক্ষেপ করে মক্কায় ফিরতে চান তবে ফিরতে পারেন, কিন্তু তা উত্তম নয় মাকরূহ। সুন্নাত সময় হল সূর্য ঢলার পর থেকে সূর্য অস্ত যাওয়া পর্যন্ত। এ দিন সূর্য অস্ত যাওয়ার পর সময় মোটেই থাকেনা। * ১২ বা ১৩ই যিলহজ্জ কংকর নিক্ষেপের পর মক্কায় ফেরার সময় সুন্নাত হল 'মুহাসাব' নামক স্থানে (বর্তমান নাম মু'আবাদা) কিছুক্ষণ অবস্থান করা। বরং পূর্ণ সুন্নাত হল সেখানে যোহর, আসর, মাগরিব ও ইশার নামায পড়া। অনন্তর কিছুক্ষণ শুয়ে বা নিদ্রা যেয়ে তারপর মক্কায় ফিরে যাওয়া। এই পর্যন্ত মিনায় অবস্থান ও কংকর নিক্ষেপের কাজ শেষ হল।
তামাত্তু হজ্জের ১৪ নাম্বার কাজ হল বিদায়ী তওয়াফ করা। এই বিদায়ী তওয়াফ করা ওয়াজিব। বিদায়ী তওয়াফ করলে হজ্জে তামাত্তুর কার্যাবলী শেষ হবে। নিম্নে বিদায়ী তওয়াফ সম্পর্কে বিস্তারিত বর্ণনা পেশ করা হল। বিদায়ী তওয়াফের মাসায়েলঃ * মক্কা শরীফ থেকে বিদায়ের পূর্ব মুহূর্তে এ তওয়াফ করতে হয়। বিদায়ী তওয়াফ করা ওয়াজিব। না করলে দম দিতে হবে। তবে মহিলাদেরকে যদি হায়েযের দিনগুলোতে রওয়ানা হতে হয়, তাহলে তওয়াফ না করেই রওয়ানা হবেন, তাতে দম দিতে হবেনা। এ অবস্থায় তারা মসজিদে হারামে প্রবেশ না করে যে কোন দরজার দিকে বাইরে দাঁড়িয়ে দুআ করে নিবেন। এভাবে দূর থেকেই কা'বা শরীফের যিয়ারত করে বিদায় নিবেন। * বিদায়ী তওয়াফে রমল ও এজতেবা করতে হয় না। * বিদায়ী তওয়াফের পর সায়ী নেই। * তওয়াফ শেষে মুল্তাযাম, কা'বা শরীফের দরজা, হাতীম প্রভৃতি স্থানে দুআ ও যমযমের পানি পান করে সর্বশেষ মুহূর্তে বিরহের বেদনা নিয়ে দুআ করুন, বিশেষভাবে এটাই যেন বায়তুল্লাহর শেষ যিয়ারত না হয়-আবারও যেন আসার তওফীক হয় এই মর্মে দুআ করে বিদায় নিন। তবে পূর্বেও বলা হয়েছে মহিলাগণ পুরুষদের সাথে ধাক্কাধাক্কি করে বা কাউকে কষ্ট দিয়ে বা শালীনতা বর্জন করে মুল্তাযাম, কা'বা শরীফের দরজা, হাতীম প্রভৃতি স্থানে যাবেননা। * তওয়াফে যিয়ারতের পর কোন নফল তওয়াফ করে থাকলেও বিদায়ী তওয়াফের ওয়াজির আদায় হয়ে যায়। আপনার হজ্জের কাজ সমাপ্ত হল। এখন মদীনা শরীফ যাওয়ার থাকলে যিয়ারতের মাসায়েল ও নিয়ম-কানুন শিক্ষা করতে থাকুন। আর দেশে ফেরার হলে সফর থেকে প্রত্যাবর্তনের মাসায়েল ও আদব শিক্ষা করতে থাকুন। পূর্বে এ সম্পর্কে বর্ণনা পেশ করা হয়েছে। দেশে ফেরা বা মদীনা যাওয়ার আগ পর্যন্ত বেশী বেশী নফল তওয়াফ করতে থাকুন। চাইলে নফল উমরাও করতে পারেন। তবে নফল উমরার চেয়ে নফল তওয়াফ অধিক উত্তম। মসজিদে হারামে যত্নের সাথে জামাতে নামায আদায় করতে থাকুন। মসজিদে হারামে এক নামায অন্য মসজিদে এক লক্ষ নামাযের সমান। তবে মহিলাদের জন্য ঘরে নামায পড়ার মধ্যেই ফযীলত নিহিত। এ সম্পর্কে পূর্বে বিস্তারিত আলোচনা পেশ করা হয়েছে। মহিলাগণ আবারও সে আলোচনাটুকু দেখে নিতে পারেন। * বিদায়ী তওয়াফের পর আর মসজিদে হারামে যাওয়া যায় না- এ কথাটি ভুল বরং বিদায়ী তওয়াফের পরও মক্কা শরীফে আরও সময় থাকা হলে এবং নামাযের সময় হলে মসজিদে হারামে গিয়ে নামায আদায় করা, সময় সুযোগ হলে আরও নফল তওয়াফ করা জায়েয়। অযথা নিজেকে এই বরকত থেকে বঞ্চিত রাখা ঠিক নয়। তবে বিদায়ী তওয়াফের পর রওয়ানা করতে বিলম্ব হয়ে গেলে রওয়ানা হওয়ার পূর্ব মুহূর্তে আবার বিদায়ী তওয়াফ করে নেয়া মোস্তাহাব ও উত্তম। (মদীনা যিয়ারতের বিস্তারিত নিয়ম-কানুন ও মাসআলা মাসায়েল জানার জন্য দেখুন ১৯৫ পৃষ্ঠা।) এ পর্যন্ত তামাত্তু হজ্জের বর্ণনা সমাপ্ত হল